Boxed Style

আইফোন জিতে ক্লিক করুন

Thursday 12 December 2013

আশার দীপশিখা জ্বালাতে পারলেন না অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো



'ভিনি, ভিডি, ভিসি'_ তিনি এলেন, দেখলেন, জয় করলেন। জাতিসংঘের বিশেষ দূত সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর পাঁচ দিনের ঝটিকা সফর শেষে গণমাধ্যম ওপরের কথাগুলো লিখতে পারল না। এই পাঁচ দিনে তেমন একটা মুখ না খুললেও বাংলাদেশ থেকে বিদায় নেওয়ার আগে হাস্যমুখে তারানকো জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে দীর্ঘক্ষণ কথা বললেন। অনেক কথাই বললেন তিনি। বাংলাদেশের প্রচুর প্রশংসা করলেন। তবে আশার দীপশিখা জ্বালাতে পারলেন না। বারবার শুধু বললেন, দুই দলের মধ্যে সরাসরি সংলাপ হচ্ছে। দু'দলই আরও আলোচনায় একমত হয়েছে। সফর সফল হয়েছে কি? সাংবাদিকরা একাধিকবার এ প্রশ্ন করলেও তারানকো শুধু মধুর হাসি উপহার দিয়েই তাদের সন্তুষ্ট করতে চেয়েছেন।
গতকাল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির শীর্ষ নেতাদের বৈঠকে বরফ গলার কোনো লক্ষণ ছিল না। বিএনপির এক শীর্ষ নেতা সমকালকে বলেছেন, তারা আওয়ামী লীগ নেতাদের জানিয়েছেন, শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী রেখে তারা নির্বাচনে যাবেন না। তাদের এ অবস্থান অপরিবর্তনীয়। একই সঙ্গে তারা ফলপ্রসূ আলোচনার স্বার্থে কারাগারে আটক তাদের শীর্ষ নেতাদের মুক্তি ও দমন-পীড়নের পথ পরিহারের ওপর জোর দিয়েছেন। এ ব্যাপারে আলোচনায় অংশগ্রহণকারী আওয়ামী লীগের নেতারা সরাসরি মুখ না খুললেও বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, সরকারি দল প্রধান বিরোধী দলকে নির্বাচনে আনার জন্য নমনীয় মনোভাব প্রদর্শন করেছে। প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা সীমিত করার ব্যাপারে তারা আলোচনার আগ্রহ দেখিয়েছেন। তারা বলেছেন, ফলপ্রসূ আলোচনার জন্য সহিংসতা বন্ধ করতে হবে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল বলছেন, এহেন পরিস্থিতিতে
বিরাজমান গুরুতর সংকটের সুরাহা দৃশ্যমান হচ্ছে না। তারা বলছেন, কাদের মোল্লার ফাঁসিকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে যে সহিংসতা চলছে, তা অন্য শক্তির ক্ষমতায় আশার আশঙ্কাকে আরও ঘনীভূত করছে। তারা বলছেন, নিরীহ মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে। ঢাকা থেকে দেশের বৃহৎ অংশ প্রায় বিচ্ছিন্ন। কোটি কোটি মানুষের মধ্যে ভয়াবহ নিরাপত্তাহীনতা। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য সরকারের নিশ্চয়ই কিছু করণীয় আছে।
তারানকোর সংবাদ সম্মেলন :জাতিসংঘের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, রাজনৈতিক নেতাদের সদিচ্ছা ও সমঝোতামূলক মনোভাবের ওপর নির্ভর করছে এ সংকটের সমাধান। পাঁচ দিনের সফর শেষ করার আগে গতকাল বুধবার সোনারগাঁও হোটেলে আয়োজিত জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ মন্তব্য করেন। জাতিসংঘের এই সহকারী মহাসচিব বলেন, উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে উত্তেজনা প্রশমন ও গঠনমূলক সংলাপ চালিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এখনও সমস্যা রয়েছে। তবে রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে চলমান অচলাবস্থা নিরসন এখনও সম্ভব বলে মনে করেন জাতিসংঘের এই সহকারী মহাসচিব। মিশন সফল কি-না_ এ রকম এক প্রশ্নের জবাবে কিছুটা হাসিমুখে তারানকো বলেন, যতটুকু অগ্রগতি হয়েছে, তাতে আমি খুশি। উভয় পক্ষের নেতাদের এক টেবিলে বসানো সম্ভব হয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সংলাপে দু'পক্ষের মধ্যে বিস্তর মতপার্থক্য থাকায় তার সাফল্য নিয়ে সংশয় কাটছে না।
সংবাদ সম্মেলনে তারানকো বলেন, গঠনমূলক সংলাপ চলমান থাকলে সমাধানের উপায় একটা বের হবেই। বাংলাদেশের জনগণেরও এটাই প্রত্যাশা। তিনি চলমান সংলাপকে ইতিবাচক উল্লেখ করে বলেন, তৃতীয় দফা সংলাপে বসতে উভয় পক্ষ রাজি হয়েছে। নেতারা দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। তবে সংলাপকে জীবিত রাখতে অবশ্যই স্পেস রাখতে হবে।
তারানকো বলেন, তিনি নিউইয়র্কে ফিরে গিয়ে জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের কাছে এ সফর সম্পর্কে বিস্তারিত অবহিত করবেন। গতকাল রাত সাড়ে ৯টার দিকে নিউইয়র্কের উদ্দেশে তিনি ঢাকা ত্যাগ করেন। রাজনৈতিক সংকট নিরসনের লক্ষ্যে তিনি গত শুক্রবার বাংলাদেশ সফরে আসেন। শনিবার থেকে তিনি কঠিন মিশন শুরু করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়া, দু'দলের জ্যেষ্ঠ নেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, নির্বাচন কমিশন, নাগরিক সমাজ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এক পর্যায়ে তিনি মঙ্গলবার থেকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি মহাসচিবদের নেতৃত্বে দু'দলকে সংলাপে বসাতে সমর্থ হন। তার মধ্যস্থতায় দু'দফা বৈঠক হয়।
তারানকো দু'দলের সংলাপের প্রশংসা করে বলেন, সদিচ্ছা থাকলে উপায় একটা বের হবেই। তিনি এ ক্ষেত্রে কয়েকটি পদক্ষেপ খুবই কার্যকর হবে বলে উল্লেখ করেন। এসব পদক্ষেপ হলো সহিংসতার পরিসমাপ্তির লক্ষ্যে সব পক্ষকে আহ্বান জানানো, রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তি দেওয়া এবং নির্বাচনের তফসিলের বিষয়ে পারস্পরিক সন্তোষজনক একটি সমাধানে পেঁৗছানো। সংকট সমাধানে প্রস্তাব নিয়ে আসাটা গুরুত্বপূর্ণ। এটাই বাংলাদেশের মানুষ চায়।
জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব বলেন, চলমান রাজনৈতিক সংকটের কারণে বাংলাদেশকে মানবিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রচুর মূল্য দিতে হচ্ছে। এটা উত্তেজনা বৃদ্ধি করছে এবং বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে যে অর্জন করেছে, তার জন্য হুমকির সৃষ্টি করেছে। তিনি এ সময় জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুনের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, 'সহিংসতার কারণে মহাসচিবের উদ্বেগের কথা আমি সবাইকে বলেছি। এ সহিংসতার ভিকটিমদের বেশির ভাগই নারী-শিশুসহ নিরীহ সাধারণ মানুষ। আমি সবাইকে সর্বোচ্চ ধৈর্য ধারণ এবং মানবাধিকার ও আইনের শাসনকে ঊধর্ে্ব তুলে ধরার জোরালো আহ্বান জানিয়েছি। সব মানুষের নিরাপত্তার বিষয়ে নেতাদের পদক্ষেপই এখানে সবচেয়ে বড় বিষয় বলে আমি মনে করেছি।'
তারানকো বলেন, জাতিসংঘ অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক এবং অহিংস নির্বাচনের পক্ষে। এটা স্পষ্ট যে, বাংলাদেশের জনগণ এটা চায় এবং এটা তাদের প্রাপ্য। এ নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নির্ভর করবে সার্বিকভাবে বাংলাদেশের জনগণের ওপর। তিনি বলেন, একমতে পেঁৗছার ক্ষেত্রে গ্রাউন্ড রয়েছে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। বাংলাদেশের নেতাদের একমতে পেঁৗছার কাজ অব্যাহত রাখতে হবে। সদিচ্ছা ও সমঝোতার মনোভাব নিয়ে সংলাপ চালিয়ে যেতে হবে।
মিশন সফল নাকি ব্যর্থ :তারানকোর কাছে প্রশ্ন ছিল_ তার সফর সফল, নাকি ব্যর্থ হয়েছে। তিনি মুচকি হেসে বলেন, 'আই অ্যাম হ্যাপি উইথ দ্য প্রগ্রেস।' তিনি বলেন, 'অনেক উদ্বেগ ও চ্যালেঞ্জ ছিল। এ সময়ে তাই আমাকে আসতে হয়েছে। আমি অত্যন্ত খুশি যে, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে একসঙ্গে বসা দেখতে পেরেছি। তারা প্রস্তাব ও সুপারিশ নিয়ে আসছেন। এখন সমঝোতা করতে পারলে সুষ্ঠু নির্বাচন ও উত্তেজনা প্রশমন সম্ভব।' এ সফরে আপনি যা চেয়েছিলেন, তা কি অর্জন করতে পেরেছেন_ এ প্রশ্নের জবাবে তারানকো বলেন, 'হ্যাঁ, আমি অর্জন করতে পেরেছি। দুই পক্ষকে সংলাপে বসানো সম্ভব হয়েছে। এখন এটা চালিয়ে যেতে হবে।'
জাতিসংঘ সংবিধানের কাঠামোর মধ্য থেকেই সংকটের সমাধান চায় কি-না_ জানতে চাইলে তারানকো বলেন, 'এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলতে চাই না। দুই পক্ষের সংলাপে যুক্ত থাকার অনেক ইস্যু রয়েছে। তবে ইচ্ছা থাকলে উপায় হবে।' তারানকো বলেন, সহিংসতা বন্ধ করার বিষয়ে সব রাজনৈতিক দলকে আলোচনা করতে হবে। রাজনৈতিক নেতা ও নাগরিকদের দায়িত্বশীল হতে হবে। সংলাপ ব্যর্থ হলে কী হবে_ জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এ বিষয়ে কিছু বলতে চাই না। এটা সবাই জানে, সংলাপ ব্যর্থ হলে কী হবে।'
অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর কাছে জানতে চাওয়া হয়, রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে সদিচ্ছার ঘাটতি দেখেছেন কি-না। জবাবে তিনি বলেন, 'এমন কোনো কিছু দেখিনি।' নির্বাচনের তফসিল পেছানোর কোনো কিছু লক্ষ্য করেছেন কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'এটি রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একমত হওয়ার ইস্যু।'
কাদের মোল্লার ফাঁসি প্রসঙ্গ :কাদের মোল্লার ফাঁসি সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এ বিষয়ে জাতিসংঘের মানবাধিকার-সংক্রান্ত হাইকমিশনার বলেছেন। জাতিসংঘ নীতিগতভাবে মৃত্যুদণ্ডের বিরোধী। এ বিষয়ে শেষ মুহূর্তে আপিল করা হয়েছে। নির্বাচনের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টিতে রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ এবং বাংলাদেশের জনগণকে ভূমিকা পালন করতে হবে।
তৃতীয় দফায় সফর :জাতিসংঘের রাজনীতি-সংক্রান্ত সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো এবার তৃতীয় দফায় বাংলাদেশ সফর করলেন। এর আগে গত বছরের ডিসেম্বরে ও চলতি বছরের মে মাসে দু'বার বাংলাদেশ সফর করে রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করেন। ওই সফরের ফলোআপ হিসেবেই এবার বাংলাদেশে আসেন তিনি।
গত শুক্রবার চার দিনের সফরে এসে তারানকো দফায় দফায় বৈঠক করেন বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে। তিনি তার মিশন শুরু করেন পরের দিন শনিবার পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হকের সঙ্গে বৈঠকের মাধ্যমে। তারপর তিনি বৈঠক করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে প্রথম দিন বৈঠক হলেও দ্বিতীয় দফায় আরেকটি বৈঠক শেষ পর্যন্ত হয়নি। যদিও তারানকো বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিতীয় দফায় বৈঠক করবেন বলে শোনা গিয়েছিল। তবে বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়ার সঙ্গে দু'দফা বৈঠক হয়েছে জাতিসংঘের এ কূটনীতিকের।http://adf.ly/?id=353839