Boxed Style

আইফোন জিতে ক্লিক করুন

Sunday 22 December 2013

সিক্স মার্ডার :গোপীবাগে একই বাড়িতে ছয়জনের গলা কাটা লাশ


রাজধানীর গোপীবাগের একটি বাসায় ছয়জনকে গলা কেটে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা।
সিক্স মার্ডারসমকাল প্রতিবেদক
রাজধানীর গোপীবাগের একটি বাসায় ছয়জনকে গলা কেটে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় রামকৃষ্ণ মিশন রোডের ৬৪/৬ নম্বরের চারতলা বাসার দ্বিতীয় তলার ফ্ল্যাটে এ ঘটনা ঘটে। নিহত সবাই পুরুষ।
তাদের মধ্যে দু'জন হলেন ওই ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়া লুৎফর রহমান ফারুক (৫৫) ও তার ছেলে সানোয়ার ইসলাম মনির (৩০)। অন্যরা হলেন_ মঞ্জু (৩০), মজিবুর রহমান (২৮), রাসেল (৩৭) ও শাহীন (২৪)। লাশগুলো ওই ফ্ল্যাটের দুটি কক্ষের খাটে ও মেঝেতে পড়ে ছিল।
লুৎফর নিজেকে পীর হিসেবে পরিচয় দিতেন। তার অনেক অনুসারী নিয়মিত ওই ফ্ল্যাটে যাতায়াত করতেন। নিহত অন্য চারজন তার অনুসারী বলে জানায় পুলিশ। মঞ্জু ছিলেন লুৎফর রহমানের খাদেম। ঘটনার পর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ ওই ভবনের বিভিন্ন ফ্লোর থেকে সন্দেহজনকভাবে ছয়জনকে আটক করেছে।
প্রায় সাত বছর আগে ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরে রাজধানীর পল্লবীর একটি বাসায় একসঙ্গে সাতজনকে গলা কেটে হত্যার ঘটনা ঘটে। ২৭ লাখ টাকা লুটের জন্য চরমপন্থিরা ওই হত্যাকাণ্ড ঘটায় বলে পরে জানা যায়। গতকালের হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য সম্পর্কে তাৎক্ষণিকভাবে অবশ্য কিছু জানা যায়নি। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রাথমিক ধারণা, মতাদর্শগত দ্বন্দ্বের কারণে উগ্রপন্থায় বিশ্বাসী কোনো দল লুৎফরসহ অন্যদের হত্যা করতে পারে। যেভাবে এর আগে ব্লগার রাজীব হায়দারকে খুন করা হয়েছিল।
ঢাকা মহানগর পুলিশের ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার ইলিয়াস শরীফ রাতে সমকালকে বলেন, ধারণা করা হচ্ছে সন্ধ্যায় ওই ছয়জনকে হত্যা করা হয়। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যায় পুলিশ। প্রত্যেককে গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। তাদের শরীরের অন্য কোথাও আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট ঘটনাস্থল থেকে আলমত সংগ্রহ করেছে।
ভবনের আশপাশের বাসিন্দারা জানান, সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে ওই বাসা থেকে নারীকণ্ঠের চিৎকার শোনা যায়। এর পরই মানুষ এগিয়ে যায়। স্থানীয়রা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে খবর দেয়। এর মধ্যেই ছয় খুনের খবরে ঘটনাস্থলে বিপুলসংখ্যক মানুষ ভিড় করতে থাকে। ৬টার পরপর ঘটনাটি ঘটলেও পুলিশ ৭টার দিকে তা জানতে পারে।
সন্ধ্যায় সরেজমিন গিয়ে স্থানীয় ও পুলিশ সূত্রে জানা যায়, বাড়ির দোতলায় দুটি কক্ষের খাটে ও মেঝেতে গলাকাটা লাশ পড়ে আছে। একটি খাটে পড়ে ছিল লুৎফর ও তার ছেলেসহ চারজনের মৃতদেহ। আরেকটি কক্ষের মেঝেতে আরও দু'জনের রক্তাক্ত দেহ। নিহত সবার মুখে স্কচটেপ এবং গামছা ও লুঙ্গি দিয়ে হাত-পা বাঁধা ছিল।
বাড়ির আসবাবপত্র অগোছালো ছিল। ওই ফ্ল্যাটের অন্য একটি কক্ষে আটকে রাখা হয় লুৎফর রহমানের স্ত্রী, অনুসারীসহ চার নারী ও দুই শিশুকে। তাদেরও হাত-পা বাঁধা ছিল। তাদের মধ্যে লুৎফরের স্ত্রী সালমা, তার ছেলের স্ত্রী বীথি ছাড়াও গোলাপি ও রুমি নামের দু'জন ছিলেন বলে জানা গেছে। এছাড়া লুৎফরের আধ্যাত্মিক সেকেন্ড-ইন কমান্ড আছমাকেও আটকে রাখা হয়। পুলিশ তাদের উদ্ধার করেছে। খুনিরা ফ্ল্যাটে অবস্থান করা ছয় পুরুষকেই হত্যা করে।
এদিকে, গতকাল রাত পৌনে ১টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ঘটনাস্থল দোতলার ফ্ল্যাটের ভেতরে সাংবাদিকরা ঢুকতে পারেননি। ভেতরের চিত্র দেখতে পারেননি সাংবাদিকরা। পুলিশ ও গোয়েন্দারা সেখানে তাদের দায়িত্ব পালন করছিলেন। পুলিশের ওয়ারী বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার মেহেদী হাসান জানিয়েছেন, নিহত ফারুক আধ্যাত্মিক সাধনা করতেন।
মঞ্জু, মজিবুর, রাসেল ও শাহীন লুৎফরের অনুসারী বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। ঘটনার সময় বাসায় অন্তত ১২ জন ছিলেন। তাদের মধ্যে পরিবারের সদস্য ছাড়াও লুৎফরের কয়েকজন অনুসারী ছিল। ওই ফ্ল্যাটে ডাকাতি বা মালপত্র লুটপাটের কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ৭-৮ জন যুবক সন্ধ্যা ৬টার দিকে ওই বাসায় ঢোকে। এর পর তারা বাসার সবাইকে জিম্মি করে ছয়জনকে গলা কেটে হত্যা করে। বাকিদের অন্য একটি কক্ষে আটক রাখা হয়।
ওই ভবনের পাশের ভবনের দোতলার বাসিন্দা মফিজ উদ্দিন বলেন, 'পাশের ফ্ল্যাট থেকে চিৎকার শুনতে পেয়ে আমি দৌড়ে যাই। গিয়ে দেখি দরজার সামনে দুটি লাশ পড়ে আছে। একটি বয়স্ক লোকের এবং অপরজনের বয়স অপেক্ষাকৃত কম।'
বাড়ির চতুর্থ তলার ভাড়াটিয়া জহির উদ্দিন মাহমুদ সমকালকে জানান, তিন মাস আগে লুৎফর ওই বাসা ভাড়া নেন। লুৎফরের পরিবারে অনেক সদস্য ছিলেন। এ ছাড়া প্রথম থেকেই ওই বাসায় প্রচুর লোকের যাতায়াত ছিল। বাড়ির অন্য কোনো ভাড়াটিয়ার সঙ্গে লুৎফর অথবা তার পরিবারের সদস্যরা কখনও ক
থা বলতেন না। তিনি আরও জানান, ওই বাড়ির চার ফ্লোরের মালিক চার বোন। তারা কেউই ওই বাড়িতে বসবাস করেন না।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা যায়, সন্ধ্যার দিকে ৭-৮ জন লুৎফরের অনুসারী পরিচয় দিয়ে ওই বাসায় ঢোকেন। এ সময় তারা বলেন, পুলিশ তাদের তাড়া করেছে। এরপর তারা বাসায় ঢুকে নামাজ আদায় করে অন্যদের সঙ্গে মুড়ি খান। এর পরই ঘটে নির্মম হত্যাকাণ্ড। পরে মুড়িসহ ওই বাসা থেকে জব্দ করা কিছু খাবারের নমুনা রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়। সেগুলোয় বিষ বা চেতনানাশক কিছু মেশানো থাকতে পারে বলে পুলিশের ধারণা। স্থানীয় লোকজন দাবি করেন, লুৎফর একজন ভণ্ডপীর ছিলেন। রামকৃষ্ণ মিশন রোডের ওই বাসায় ওঠার আগে তিনি মতিঝিলে ভাড়া থাকতেন। নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের পর স্থানীয় লোকজন তার প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। এরপর তিনি ওই এলাকা ছেড়ে রামকৃষ্ণ মিশন রোডের ওই বাসা ভাড়া নেন।
জানা গেছে, রামকৃষ্ণ মিশন রোডের ৬৪/৬ নম্বর বাড়িটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ওয়ালিউর রহমানের স্ত্রী শিরীন আক্তারের। তারা ওই বাড়িতে বসবাস করেন না। শিরীন আক্তার জানান, সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে বাড়িটির নিরাপত্তারক্ষী সাইফুল তাকে ফোনে জানায়, বাড়িতে ঝামেলা হয়েছে। খবর পেয়ে তিনি বাসায় গিয়ে সাইফুলকে খুঁজে পাননি। তিন মাস আগে মনির মাসে ২৪ হাজার টাকায় বাসাটি ভাড়া নেন। এ সময় মনির নিজেকে সিটি ব্যাংকের কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দেন।
লুৎফরের স্ত্রী সালমা বেগম জানিয়েছেন, কয়েক যুবক সন্ধ্যার পর ঘরে ঢুকে প্রথমে নামাজ পড়ে। এরপর তারা বাসার সকলকে জিম্মি করে আর বলতে থাকে, 'ছয় জনকে মারার হুকুম হয়েছে। আমরা মারতে এসেছি। মারার পর চলে যাব।' তাদের মধ্যে এক যুবকের পরনে ছিল ব্লেজার। তার মুখে ছিল খোঁচা-খোঁচা দাড়ি। র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান বলেন, লুৎফরের স্ত্রী দাবি করেছেন, তার স্বামী বিভিন্ন সময় মৌলবাদের বিরুদ্ধে কড়া কথা বলতেন। এ কারণে কেউ ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে খুন করতে পারে।' আমরা তার বক্তব্যের বিষয়টি খতিয়ে দেখছি। আমাদেরও প্রাথমিক ধারণা কোনো মৌলবাদী গ্রুপের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে লুৎফর সহসযোগীসহ খুন হন। খুনিরা একই স্টাইলে সবাইকে হত্যা করে। তাদের হাতে ধারালো অস্ত্র ছিল।
লুৎফরের ছেলের স্ত্রী বীথি বলেন, খুনিরা এসে জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করে। এরপরই তারা নৃশংস হয়ে ওঠে। শ্বশুর জানান, রাতে দশজন মেহমান খেতে আসবেন। এজন্য সন্ধ্যার পর থেকেই রান্নার আয়োজন চলছিল। এর মধ্যেই অপরিচিত কয়েকজন বাসায় ঢুকে নামাজ পড়তে চায়। কে এই লুৎফর রহমান নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন ধরে লুৎফর রহমান নিজেকে ইমাম মেহেদীর অনুসারী হিসেবে পরিচয় দিয়ে আসছিলেন। তিনি বলে আসছিলেন, 'হজরত মোহাম্মদ (সা.) সর্বশেষ নবী নন। ইমাম মেহেদী শেষ নবী। ইমাম মেহেদী এখনও পৃথিবীতে আসেননি।
তিনি আসবেন।' এর পর ধর্মীয় অপপ্রচার চালানোর অভিযোগে বছর দেড়েক আগে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) লুৎফর রহমানকে তার কয়েক অনুসারীসহ মতিঝিল এলাকা থেকে গ্রেফতার করে। এ থেকে পুলিশ ধারণা করছে, হত্যাকাণ্ডের পেছনে তার আদর্শিক মতবাদ নিয়ে বিরোধ আছে।
বছরখানেক আগে জামিনে বের হন লুৎফর রহমান। এরপর জেলগেট থেকে ফের একটি গোয়েন্দা সংস্থা লুৎফরকে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তার পরিবারের সদস্যদের হাতে তুলে দেন।