Boxed Style

আইফোন জিতে ক্লিক করুন

Saturday 21 December 2013

সেনাবাহিনী নামছে ২৬ ডিসেম্বর


দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নির্বিঘ্ন করতে আগামী ২৬ ডিসেম্বর থেকে সারাদেশে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হচ্ছে। নির্বাচনী এলাকার আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে ও ভোটারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ভোটের পরও চার দিন মাঠে অবস্থান করবেন সেনাসদস্যরা। প্রতি জেলায় সেনাবাহিনীর একটি ব্যাটালিয়নের (৭৪০ জন সেনাসদস্য) পাশাপাশি মোতায়েন করা হবে অস্ত্রধারী আনসার সদস্যদেরও। জেলায় সেনাক্যাম্প মোতায়েন করা হলেও রিটার্নিং অফিসারের নির্দেশে তারা সংশ্লিষ্ট জেলার যে কোনো জায়গায় দায়িত্ব পালন করবেন। মূলত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সিভিল প্রশাসনকে সহায়তা করতে সেনাসদস্যরা নির্বাচনকালীন মাঠে দায়িত্ব পালন করবেন। তারা থাকবেন স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে। গতকাল দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে আগারগাঁওয়ের এনইসি সম্মেলন কক্ষে রিটার্নিং অফিসার ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকের পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদের সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েনের এ সিদ্ধান্তের কথা জানান। তিনি বলেন, নির্বাচনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সহায়তা করতে ২৬ ডিসেম্বর থেকে ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত মাঠে থাকবেন
সেনাসদস্যরা। পরিস্থিতি অনুযায়ী সেনা মোতায়েনের সময়সীমা কমবেশি হতে পারে। বৈঠকে রিটার্নিং অফিসার (ডিসি) এসপিদের সব বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার।
গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সংজ্ঞায় সেনাবাহিনী অন্তর্ভুক্ত নয়। তবে সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সব নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। সে অনুযায়ী সেনাবাহিনী তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করবে। এর আগেও বিভিন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সেনাবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে দেশ-বিদেশে প্রশংসা অর্জন করে। ভোটের দিন সেনাসদস্যদের সঙ্গে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট থাকবেন। ভোটের আগের দিনগুলোতেও যে কোনো সংঘাতপূর্ণ পরিস্থিতি মোকাবেলায় সেনা কর্তৃপক্ষ তাদের সঙ্গে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট চেয়েছে।
নির্বাচন কমিশনার শাহনেওয়াজ গতকাল সমকালকে বলেছেন, নির্বাচনী দায়িত্বের বাইরে সেনাসদস্যরা কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতায় আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা পালন করবেন না। তাই যেসব জেলায় নির্বাচন হবে না, সেখানে কোনো সেনাসদস্য মোতায়েন করা হবে না।
সূত্র জানায়, নির্বাচন ঘিরে কোনো এলাকায় সহিংস পরিস্থিতি তৈরি হলে সেখানে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সহায়তা করতে সেনাসদস্যরা ঘটনাস্থলে যেতে পারবেন।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অতীতের যে কোনো নির্বাচনের তুলনায় এবার সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা বেশি সময় ধরে মাঠে অবস্থান করবেন। ১৯৯১ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত জাতীয় নির্বাচনে তিন থেকে পাঁচ দিন আগে সেনা মোতায়েন করা হয়। ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি দেশে জরুরি অবস্থা জারির পর আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী নামানো হয়েছিল। ২০০৮ সালের নির্বাচনের কিছুদিন আগে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহারের পর সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরে যায়। এর পর নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১২ দিনের জন্য সেনা মোতায়েন করা হয়।
গতকাল শুক্রবার দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আইন-শৃঙ্খলার বৈঠকে বিভিন্ন জেলার রিটার্নিং অফিসার, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিনিধিরা উপস্থিতি ছিলেন। বৈঠকে প্রথমে জেলা রিটার্নিং অফিসারদের কাছ থেকে আইন-শৃঙ্খলা বিষয়ে মতামত নেওয়া হয়। ওই মতামতের ভিত্তিতে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ১০ দিন আগে এবং ভোট গ্রহণের চার দিন পর পর্যন্ত মোট ১৫ দিনের জন্য সেনা মোতায়েনের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়।
সেনাসদস্যদের দায়িত্ব :নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে সারাদেশের নির্বাচনী আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের জন্য ৫০ হাজার সেনাসদস্য চাওয়া হয়েছে। প্রতিটি জেলা শহরে এক ব্যাটালিয়ন সেনাসদস্য থাকবে। তারা জেলা শহর থেকে রিটার্নিং অফিসারদের পরামর্শ অনুযায়ী বিভিন্ন উপজেলায় নির্বাচনী আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে কাজ করবেন। তারা জেলা শহরেই ক্যাম্প স্থাপন করবেন। ক্যাম্পের প্রধান থাকবেন একজন লে. কর্নেল পদমর্যাদার কর্মকর্তা। নির্বাচনের দিন প্রতিটি উপজেলা বা থানায় দুই থেকে চার প্লাটুন সেনাসদস্য নিয়োগ করা হবে। নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রের অভ্যন্তরে বা ভোটকক্ষে সেনাসদস্যরা কোনো দায়িত্ব পালন করবেন না। তারা বেসামরিক প্রশাসনের নির্দেশনা অনুযায়ী সহায়তা দেবেন। ভোটের দিন তারা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটসহ ভোটকেন্দ্রের বাইরে অবস্থান নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে কাজ করবেন।
গতকালের বৈঠকে সেনাসদস্যদের সঙ্গে নির্বাচনের আগেই ম্যাজিস্ট্রেট দেওয়ার দাবি করেন সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রতিনিধি। তবে একজন নির্বাচন কমিশনার সমকালকে জানিয়েছেন, ম্যাজিস্ট্রেট দেওয়ার বিষয়টি এখনও তারা চূড়ান্ত করেননি। কোনো প্রার্থীর প্রচারে কেউ বাধা সৃষ্টি করলে সে ক্ষেত্রে সেনাসদস্যরা কোনো ভূমিকা পালন করবেন কি-না_ জানতে চাইলে ওই কমিশনার জানান, সেনাসদস্যরা ইসির নির্দেশনা অনুযায়ী নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করবেন। এ ক্ষেত্রে ইসির মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা রিটার্নিং অফিসার যে নির্দেশনা দেবেন, তারা তা-ই পালন করবেন।
তবে সশস্ত্র বাহিনী নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করলেও তাদের প্রচলিত কমান্ড ও কন্ট্রোল ব্যবস্থা বজায় থাকবে। নির্বাচনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাড়ে পাঁচ লাখ সদস্য ও সশস্ত্র বাহিনীর ৫০ হাজার সদস্য মিলিয়ে মোট ছয় লাখের বেশি সদস্য মোতায়েন করা হবে।
নির্বাচন কমিশন সচিবালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে আইন-শৃঙ্খলা সমন্বয় সেল গঠন করা হবে। এতে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, পুলিশ, আনসার, বিডিআর, কোস্টগার্ড ও গোয়েন্দা সংস্থার একজন করে প্রতিনিধি থাকবেন। তারা আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর দায়িত্বপ্রাপ্ত এলাকা সমন্বয়, নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় ও ইসির সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখবেন।
সারাদেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কারণে এবার নির্বাচনী মালপত্র ও উপকরণ সেনাসদস্যদের পাহারায় পরিবহনের বিষয়ে কমিশন চিন্তা করছে বলে জানা গেছে ।
আইন-শৃঙ্খলার উন্নতি হচ্ছে_ সিইসি :নির্বাচনী আইন-শৃঙ্খলার বৈঠক শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ সাংবাদিকদের জানান, আগামী ২৬ ডিসেম্বর থেকে সেনাবাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত হয়েছে। তারা নির্বাচনে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের সহায়তা করবেন। বর্তমানে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে বলেও দাবি করেন সিইসি। বৈঠক সূত্র জানায়, সারাদেশের আইন-শৃঙ্খলা নিয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা ও বিভিন্ন বাহিনী এবং সংস্থার উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা দাবি করেছেন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতির সঠিক চিত্র গণমাধ্যমে আসছে না।
সিইসি বলেন, আগামী ৫ জানুয়ারি ভোট গ্রহণের পর ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত সেনাসদস্যরা মাঠ পর্যায়ে দায়িত্ব পালন করবেন। তবে সার্বিক পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে কোনো কোনো এলাকায় সেনা মোতায়েনের সময়কাল কমবেশি হতে পারে। নিরাপত্তা রক্ষায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে ম্যাজিস্ট্রেট থাকবেন। শিগগিরই মাঠে নির্বাচনী প্রচার ও আচরণবিধি পর্যবেক্ষণে ম্যাজিস্ট্রেটরাও দায়িত্ব পালন করবেন।
সিইসি বলেন, 'সারাদেশের আইন-শৃঙ্খলার পরিস্থিতি শিগগিরই আরও উন্নতি ঘটবে। অবস্থার উন্নয়ন ঘটলে অনেক সংস্থাই পর্যবেক্ষক পাঠাবে। এখন পর্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ভোটকেন্দ্রের তালিকা তৈরি হয়নি। শিগগিরই আমরা চূড়ান্ত তালিকা প্রস্তুত করতে পারব।' তিনি আরও বলেন, আগামীকাল রোববার থেকে সারাদেশে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও সন্ত্রাসী গ্রেফতার অভিযান শুরু হচ্ছে। যেসব প্রার্থী নিরাপত্তা চেয়ে আবেদন করেছেন, তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। এরই মধ্যে কয়েকজনকে নিরাপত্তা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ভোটারদের নির্বিঘ্নে ভোট প্রদান ও প্রার্থীদের নির্বিঘ্নে প্রচারকাজের ব্যবস্থাও করবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
শেরেবাংলা নগরের পরিকল্পনা কমিশন চত্বরের এনইসি অডিটোরিয়ামে বিকেল ৩টায় অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে সিইসির সভাপতিত্বে নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবু হাফিজ, মোহাম্মদ আবদুল মোবারক, জাবেদ আলী, শাহনেওয়াজ, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও) লে. জেনারেল আবু বেলাল মুহাম্মদ শফিউল হক, পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার, র‌্যাবের মহাপরিচালক মোখলেছুর রহমান, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ, ডিএমপি কমিশনার বেনজীর আহমেদ, আনসার ও ভিডিপি, কোস্টগার্ড, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা (এনএসআই) প্রতিনিধি, বিভিন্ন জেলার পুলিশ সুপার, স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) প্রতিনিধি, ডিজিএফআইর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, ৬১ জন রিটার্নিং অফিসার ও ৫৭৭ সহকারী রিটার্নিং অফিসার বৈঠকে অংশ নেন।
নির্বাচনী এলাকায় ভোট গ্রহণের আগে দু'দিন ও ভোটের পর একদিন পুলিশ মোতায়েন থাকবে। আনসার মোতায়েন থাকবে ভোট গ্রহণের আগে ও পরে মিলিয়ে মোট পাঁচ দিন। এ ছাড়া স্ট্রাইকিং ও মোবাইল ফোর্স, বিভিন্ন কমিটি ও রিটার্নিং কর্মকর্তাদের নির্দেশনা-সংক্রান্ত পরিকল্পনাও রয়েছে কমিশনের।
ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী আগামী ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য ১৪৬টি আসনের নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা ৪ কোটি ৩৬ লাখ ৮ হাজার ৬৭০। ভোটকেন্দ্রের সংখ্যা ১৮ হাজার ১২৩টি। এর আগে ১৫৪ আসনে প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। ফলে ওই আসনগুলোতে আর ভোট গ্রহণ হচ্ছে না।
বিবিসিকে সাখাওয়াত হোসেন :সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন গতকাল বিবিসিকে বলেন, সেনাবাহিনী রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে কাজ করে। তাদের সেন্টারে নিয়োগ করা হয় না। নির্বাচনের আগে ও পরে কোনো খারাপ পরিস্থিতি যাতে না হয় সে জন্য তাদের মাঠে রাখা হয়।
বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনীর সামনে বড় চ্যালেঞ্জ কী? এ প্রশ্নের জবাবে সাখাওয়াত হোসেন বলেন, সেনাবাহিনী কোন এলাকায় কাজ করবে, কী করতে হবে সে বিষয়ে সঠিক নির্দেশনা দিতে হবে। তাদের ম্যাজেস্ট্রিয়াল ক্ষমতা দিতে হবে। এ জন্য তাদের সঙ্গে একজন ম্যাজিস্ট্রেট থাকতে হবে।
কয়েকটি রাজনৈতিক দল নির্বাচন প্রতিহতের ঘোষণা দিয়েছে_ এ পরিস্থিতিতে তাদের ভূমিকা কী? এ ব্যাপারে সাখাওয়াত হোসেন বলেন, এটা নির্ভর করবে নির্বাচন কমিশনের ওপর। সেনাবাহিনী সার্বিক পরিস্থিতি না শুধু নির্বাচনী পরিস্থিতি মোকাবেলা করবে_ তা ঠিক করে দিতে হবে নির্বাচন কমিশনকে।