Boxed Style

আইফোন জিতে ক্লিক করুন

Friday 20 December 2013

শনিবার থেকে আবার টানা চার দিন অবরোধ; অতঃপর?


লোটন একরাম
১৮ দলের ৭২ ঘণ্টার অবরোধের শেষ দিন বৃহস্পতিবার রাজধানীতে যান চলাচল ছিল স্বাভাবিক  সমকাল
১৮ দলের ৭২ ঘণ্টার অবরোধের শেষ দিন বৃহস্পতিবার রাজধানীতে যান চলাচল ছিল স্বাভাবিক সমকাল
দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করে 'অগি্নপরীক্ষা'র মুখে পড়েছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। নির্দলীয় সরকারের অধীনে ছাড়া নির্বাচন হবে না এবং হতেও দেওয়া হবে না ঘোষণা দিয়ে একটু বেকায়দায়ই পড়েছে দলটি। জাতিসংঘের মধ্যস্থতায়ও সমঝোতার মাধ্যমে সম্ভব হলো না দাবি আদায় করে নির্বাচনে অংশ নেওয়া। আবার দফায় দফায় টানা অবরোধের মতো 'কঠোর' আন্দোলনের কর্মসূচি দিয়েও নির্বাচন 'প্রতিহত' করতে পারছে না দলটি। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া রাজপথে নামার নির্দেশ দিলেও তাতে সাড়া দিচ্ছেন না কেন্দ্রীয় নেতারা। আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু রাজধানীতে অবরোধে জীবনযাত্রা প্রায় স্বাভাবিক। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দেশজুড়ে যৌথ বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানের মধ্যেই শিগগির সারাদেশে মোতায়েন হচ্ছে সেনাবাহিনীও। আগামী ১৫ দিনের মধ্যে নির্বাচনের ঘোষিত তফসিল স্থগিত করাতে না পারলে ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে বাকি ১৪৬টি আসনেও ভোট গ্রহণ সম্পন্ন করবে সর্বদলীয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ পরিস্থিতিতে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে বিএনপি।গত চার দিনের অবরোধ একেবারেই মুখরক্ষার হলেও গতকাল আবারও টানা ৮৩ ঘণ্টার একই কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট। শনিবার থেকে মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত অবরোধ চলবে।বিএনপির শীর্ষ নেতারা বলছেন, গণতন্ত্র রক্ষায় তারা 'শান্তিপূর্ণভাবে' আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে এ আন্দোলন যে আদৌ শান্তিপূর্ণ নয়_ সহিংস, তা ব্যাখ্যা করে বোঝানোর প্রয়োজন নেই।চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বহাল থাকলে বিএনপি 'অস্তিত্ব রক্ষা'র সংকটে পড়তে পারে বলেও মনে করছেন অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক। তারা বলছেন, আওয়ামী লীগ একবার নির্বাচন সম্পন্ন করে আবার সরকার গঠন করতে পারলে খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে আন্দোলনের মাধ্যমে মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি আদায় করা বিএনপির জন্য কঠিন হয়ে যেতে পারে। গতকালই আওয়ামী লীগের একাধিক শীর্ষ নেতা বলেছেন, ৫ জানুয়ারি নির্বাচন_ মধ্যবর্তী কোনো নির্বাচন নয়, পূর্ণ মেয়াদের নির্বাচন। বিএনপির সাংগঠনিক শক্তির সীমাবদ্ধতা এবং কাদের মোল্লা ইস্যুতে জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হওয়ায় রাজপথে সরকার পতনের মতো আন্দোলন গড়ে তোলা খুব সহজ না-ও হতে পারে বলে মনে করে সরকার। তবে ঘটনার ঘনঘটা এসব হিসাব-নিকাশ বদলে দিতে পারে।সমঝোতার সম্ভাবনা ক্ষীণ :সূত্র জানায়, জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপের মুখে রাজনৈতিক সংকট সমাধানের ব্যাপারে আশাবাদী ছিল বিএনপি। তাদের শেষ ভরসা ছিল জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকোর সফর। তারানকো আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে দু'দফা সংলাপে বসাতে পারলেও কার্যত ব্যর্থ হয় তার মিশন। অবশ্য দু'দল সংলাপ চালিয়ে যাবে এবং সদিচ্ছা থাকলে সমস্যার সমাধান হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে যান তিনি। তারানকো চলে যাওয়ার পর জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি নিল ওয়াকারের উদ্যোগে আরেক দফা সংলাপ হলেও কার্যত তা-ও ব্যর্থ হয়। ওই বৈঠকে দুই দলের প্রস্তাব লিখিতভাবে আদান-প্রদান করেন শীর্ষ নেতারা। প্রস্তাবগুলো দলীয় ফোরামে আলোচনা-পর্যালোচনা করে পরে আবার সংলাপে বসার কথা বলেছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। শুক্রবার সর্বশেষ সংলাপের পর পাঁচ দিন অতিবাহিত হওয়ায় এখন আর কোনো সম্ভাবনা অবশিষ্ট নেই।দশম সংসদ নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণের আর সুযোগ নেই বলে দাবি করেছেন আওয়ামী লীগের বেশ কয়েকজন নেতা। তাদের মধ্যে রয়েছেন তোফায়েল আহমেদ, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, ওবায়দুল কাদের ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু। অবশ্য আওয়ামী লীগ নেতাদের বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেছে বিএনপি। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক বিবৃতিতে বলেছেন, তারানকোর তত্ত্বাবধানে দুই দলের মধ্যে আলোচনা হয়েছিল দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে; একাদশ নিয়ে নয়। বিরোধী দলের দাবি অনুযায়ী অবিলম্বে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। না হলে বর্তমান আন্দোলনকে জনগণ 'চূড়ান্ত বিজয়ের' পথে নিয়ে যাবে।সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ মনে করে, সমঝোতার মাধ্যমে বিএনপিকে ছাড় দিলে আওয়ামী লীগের লোকসান হবে; বরং ছাড় না দিয়ে নির্বাচন করলে আবারও তারা ক্ষমতায় যেতে পারবে। আন্দোলনের মাধ্যমে নির্বাচন প্রতিহত এবং নবনির্বাচিত সরকারের পতন ঘটানো বিএনপির জন্য কঠিন বলে মনে করেন দলটির শীর্ষ নেতারা। এ পরিস্থিতিতে আর সংলাপে না বসে বিএনপিকে বাইরে রেখেই নির্বাচন সম্পন্ন করার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন তারা।সাংগঠনিক দুর্বলতা :রাজনৈতিক সমঝোতা না হলে কঠোর আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায়ের সিদ্ধান্ত রয়েছে বিএনপির। দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করতে অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছেন দলের শীর্ষ নেতারা। পাশাপাশি বিএনপি সমর্থক পেশাজীবী সংগঠনগুলোর নেতৃবৃন্দের সঙ্গেও মতবিনিময় করেছেন বিএনপি চেয়ারপারসন। সবাইকে চূড়ান্ত আন্দোলনে সব ভেদাভেদ ভুলে রাজপথে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। ঢাকা মহানগরকে আটটি অঞ্চলে ভাগ করে আটজন নেতাকে সমন্বয়ের দায়িত্বও দিয়েছেন। কিন্তু কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। দৃশ্যপটও বদলাচ্ছে না।চতুর্থ দফা অবরোধে ঢাকার রাজপথ ছিল বিএনপির নেতাকর্মীশূন্য; বরং আগের চেয়ে নগরীতে যানবাহন চলাচল করেছে বেশি। যানজটও লেগে ছিল নগরজুড়ে। জীবনযাত্রাও ছিল অনেকটাই স্বাভাবিক। আন্দোলন-সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু খোদ রাজধানীর রাজপথেই নেতাকর্মী না নামায় আন্দোলনের সফলতা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন অনেকেই। হতাশাগ্রস্ত সাধারণ কর্মীরা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন কেন্দ্রীয় নেতাদের বিরুদ্ধে। অনেকে বলছেন, গত ৭২ ঘণ্টার অবরোধে প্রমাণিত হয়েছে, বিএনপির ওপর নাখোশ জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা মাঠে না থাকায় অবরোধ অর্থহীন হয়েছে।দলের যুগ্ম মহাসচিব রিজভী আহমেদকে গ্রেফতারের পর নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয় নেতাকর্মীশূন্য বিরান ভূমির রূপ পেয়েছে। কয়েকজন অফিসকর্মী ছাড়া সেখানে কেউ নেই। এমনকি কম্পিউটার অপারেটররা পর্যন্ত নেই সেখানে। মাঝেমধ্যে সাংবাদিকরা সেখানে ভিড় জমান। কার্যালয়ের গেটে পুলিশি পাহারার দৃশ্য স্থায়ী রূপ পেলেও নেতারা আজকাল ওমুখো হন না।বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান সমকালকে বলেন, বিএনপির নেতাকর্মীরা শিগগির সব বাধা উপেক্ষা করে ব্যাপক হারে রাজপথে নেমে আসবেন। নেতাদের অনেককে সরকার কারারুদ্ধ করেছে। অনেকের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা, হুলিয়া দিয়ে রেখেছে। এ পরিস্থিতিতে কিছুটা কৌশলী ভূমিকা নিয়ে এগোচ্ছেন তারা।রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্বে কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের রাজপথে ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা। সেখানে অজ্ঞাত স্থানে চলে গেছেন তারা। বাংলাদেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপটে সরকারের শেষ মুহূর্তের আন্দোলন-সংগ্রামে বিরোধী দলের সিনিয়র নেতারা পর্যন্ত রাজপথে নেমে আসেন। এতদিন এটা রাজনীতির একটি চেনা দৃশ্য হিসেবেই ছিল। এবার মহাজোট সরকারের আমলে বিএনপির নেতারা সে ভূমিকায় নামতে পারেননি।জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব :নিজ দলের সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে দলের ভেতরে ও বাইরে ব্যাপক সমালোচনার মুখেও জামায়াতের সঙ্গ ছাড়েনি বিএনপি। মূল দল, ছাত্রদল, যুবদলসহ অন্যান্য অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা গা বাঁচিয়ে চললেও ঝুঁকি নিয়ে হরতাল-অবরোধে পিকেটিং করে আসছে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা। কিন্তু মানবতাবিরোধী অপরাধে দলের শীর্ষ নেতাদের ফাঁসির রায় হওয়ার পর তাদের পক্ষে বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করায় অসন্তুষ্ট জামায়াত। সর্বশেষ কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর করার পরও বিএনপির নীরবতায় স্বভাবতই ক্ষুব্ধ হয় জামায়াত।এ পরিস্থিতিতে বিএনপিসহ ১৮ দলের আহ্বানে অবরোধে রাজপথে পিকেটিং থেকে বিরত রয়েছে জামায়াত-শিবিরের নেতাকর্মীরা। নিজেদের হরতাল কর্মসূচি সফল করতে ঝুঁকি নিয়ে মাঠে নামলেও জোটের কর্মসূচিতে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করছে তারা। জামায়াত ছাড়া বিএনপির রাজপথে সাংগঠনিক শক্তি কম প্রমাণ করতে চায় দলটি। এ পরিস্থিতিতে ক্ষুব্ধ জামায়াত এ মুহূর্তে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থেকে বিদায় হলেও বিএনপি ক্ষমতায় আসুক, তা চায় না। তবে কৌশলগত কারণে প্রকাশ্যে তারা ১৮ দলীয় জোট বা বিএনপির বিপক্ষে কিছু বলছে না। জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কের অবনতিতে চলমান আন্দোলনের সফলতা নিয়ে বিএনপি হাইকমান্ড কিছুটা চিন্তিত বলে জানা গেছে।অবরোধের নতুন কর্মসূচি :বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে গতকাল দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান আগামীকাল শনিবার সকাল ৬টা থেকে আবার ৮৩ ঘণ্টার অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। রাজপথ, রেলপথ ও নৌপথের এ অবরোধ চলবে মঙ্গলবার বিকেল ৫টা পর্যন্ত। 'প্রহসনের' নির্বাচন বাতিল ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আজ সকালে জোটের চতুর্থ দফা অবরোধ শেষ হলো।নজরুল ইসলাম খান বলেন, সরকার একদিকে পাতানো নির্বাচনের নাটক করছে; অন্যদিকে দেশব্যাপী খুন, হত্যা, গ্রেফতার, নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে। তাই চলমান আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। তিনি বলেন, ২৫ ডিসেম্বর খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুষ্ঠান 'বড়দিনের' কথা বিবেচনায় রেখেই মঙ্গলবার বিকেল ৫টা পর্যন্ত এ অবরোধ কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে।নজরুল ইসলাম খান জানান, ২১ ডিসেম্বর জাতীয় টিকা দিবস উপলক্ষে জাতিসংঘ ও স্বাস্থ্য বিভাগের যানবাহন, সংবাদপত্র ও সংবাদপত্রবাহী গাড়ি, লাশবাহী গাড়ি ও অ্যাম্বুলেন্স অবরোধের আওতামুক্ত থাকবে।