Boxed Style

আইফোন জিতে ক্লিক করুন

Saturday 23 November 2013

বিমলাংশুর আলো

বিদেশে সুনাম কুড়ানোর পর দেশের জন্য কিছু করতে চেয়েছিলেন কৃতী চিকিত্সক বিমলাংশু রঞ্জন দে। ছবি: খালেদ সরকারবিমলাংশু শব্দটার অর্থ নির্মল কিরণ। যে আলোকরশ্মিতে কোনো কালিমা, কোনো ময়লা নেই। বাইরের হরতাল-ককটেল-মিছিল-আগুন এসব পেরিয়ে হোটেলের লবিতে ঢোকার একটু পরই সেই রকম নির্মল রশ্মি ছড়ানো হাসি হেসে অভ্যর্থনা জানালেন বিমলাংশু রঞ্জন দে। গেল সপ্তাহে ঢাকা মেডিকেল কলেজে দেশের প্রথম অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন কেন্দ্র উদ্বোধন উপলক্ষে দেশে এসেছেন তিনি। এই অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন কেন্দ্র গড়ে  তোলার পেছনে যাঁর উদ্যোগ, কঠোর পরিশ্রম ও অবদানের কথা সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হওয়ার কথা, তিনি এই বাংলাদেশের একজন সফল সন্তান বিমলাংশু রঞ্জন দে। এই কেন্দ্র যখন অচিরেই সফলভাবে কাজ শুরু করবে, আর লিউকেমিয়াসহ সব ধরনের রক্ত ক্যানসারের সফল চিকিৎসা অতি অল্প খরচে হাতের নাগালে আসবে বাংলাদেশের মানুষের, তখন সেসব ক্যানসার আক্রান্ত রোগীর চোখে আশার রশ্মি হয়ে বেঁচে থাকবেন তিনি।

অথচ এই মানুষটির নাকি চিকিৎসক হওয়ারই কোনো পরিকল্পনা ছিল না। আর যখন হয়েও গেলেন, আর বিদেশে সুনাম কুড়ানোর পর দেশে কিছু করতে চাইলেন, তখনো অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন নিয়ে নাকি কোনো ভাবনাচিন্তা ছিল না। দেশে এসেছিলেন অন্য কাজে। অথচ জীবন কাকে দিয়ে কোন কাজটি করিয়ে নেবে বা নিতে চায়, তা বোঝা মুশকিল। কীভাবে এই বৃহৎ কর্মযজ্ঞের সঙ্গে তিনি একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়লেন, সে গল্প শুনতে হলে যেতে হবে একটু পেছনে, ২০০৬ সালে। ওই সময় থেকে তাঁর দেশে যাতায়াতের শুরু।
২০০৮ সালে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো একটা সফল আন্তর্জাতিক ক্যানসার সিম্পোজিয়াম অনুষ্ঠিত হয়েছিল, চিকিৎসক সমাজে অনেকেরই হয়তো মনে আছে সেটার কথা। বাংলাদেশে ক্যানসার চিকিৎসার পথিকৃৎ অধ্যাপক করিম বেঁচে ছিলেন তখনো। তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ও উদ্যোগে, সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন থেকে আসা চিকিৎসক বিমলাংশু ও তাঁর সহকর্মীদের অংশগ্রহণে বেশ সফল হয়েছিল সিম্পোজিয়ামটি। ওটাই ছিল মূল অনুপ্রেরণা। তার পরপরই বিশ্বখ্যাত গাইনি অনকোলজিস্ট গুডম্যানের সঙ্গে বাংলাদেশে হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস টিকার একটা ট্রায়াল বা গবেষণাকাজে জড়িয়ে পড়েন তিনি। ৫০ জনকে নিয়ে দুই বছরের মাথায় এই ট্রায়ালটি সফলভাবে সমাপ্ত হয়। উৎসাহ-উদ্দীপনা বাড়ে। তাঁর মনে হতে থাকে যে বাংলাদেশেও আন্তর্জাতিক মানের গবেষণাকাজ সফলভাবেই করা সম্ভব। এই সময় তাঁর পরিচয় হয় চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী এ কে খানের সঙ্গে। অনেক কথা হয় দুজনের মধ্যে, অনেক ভাববিনিময় ও স্বপ্ন বিনিময়। ফলে ২০১০ সালে গড়ে ওঠে এ কে খান হেলথ কেয়ার ট্রাস্ট। এই ট্রাস্টের অধীনে বিমলাংশু দুটি প্রজেক্টে হাত দেন। এক. বাংলাদেশে নার্সিং সেবার মান উন্নতকরণ প্রকল্প। দুই. নারীদের জরায়ুমুখের ক্যানসার রোধে সচেতনতা, স্ক্রিনিং ও চিকিৎসা প্রকল্প। নার্সিং ব্রিজ প্রকল্পে বাংলাদেশের সেবিকাদের আন্তর্জাতিক মানের উন্নত সেবা দেওয়ার প্রশিক্ষণ দিতে বোস্টন থেকে আসেন জুডি ফস্টারসহ আরও অনেক স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব। আর তাঁর সঙ্গে কড়াইল বস্তিতে শুরু হয় নারীদের জরায়ুমুখ ক্যানসার রোধ, নির্ণয় ও চিকিৎসা প্রকল্পের কাজ। জোরেশোরে চলতে থাকে এসব প্রকল্প। নিজে তিনি একজন সফল অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন বিশেষজ্ঞ হলেও, সেদিকে নজর দেওয়ার তখন সময় ছিল না মোটেও। তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন এসব কাজে। এই কাজগুলো করতে গিয়ে সরকারের বিভিন্ন মহলে শুরু হলো তাঁর নিত্য যাতায়াত। এর তিন-চার মাস পর, এই কাজ নিয়ে কথা বলতে একদিন গেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হকের কাছে। ঘটনার সূত্রপাত সেই দিনই।
স্বপ্নটা সবারই
বিমলাংশু দের এই হাসিই ভরসা জোগায় রোগীদেরস্বাস্থ্যমন্ত্রী সরাসরি তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি যে বিষয়ের বিশেষজ্ঞ, সেটা নিয়ে কেন কোনো দিন কথা বলো না? শুনে একটু হকচকিয়েই গেলেন বিমলাংশু। মন্ত্রী বলে চলেছেন—এটা তাঁর একটা স্বপ্ন যে বাংলাদেশেই সফলভাবে হবে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন, আর রক্ত ক্যানসারের রোগীদের বিদেশে যেতে হবে না, আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসা মিলবে এখানেই, আর এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে কি তিনি সাহায্য করতে পারেন না? খানিকটা থমকে গেলেন বিমলাংশু দে। চুপ করে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, ‘আমাদের দেশ এ রকম একটা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য এখনো তৈরি নয়।’

মন্ত্রীও নাছোড়বান্দা—বেশ, তৈরি হতে কত দিন লাগতে পারে মনে হয়? যদি এখনই কাজে নামা যায়?

বিমলাংশু হাসেন সেদিনটির কথা মনে করে। সেদিন ওই ঘরটিতে আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন, তাঁর ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালের ক্যানসার গবেষক দল থেকে শুরু করে ঢাকা মেডিকেল কলেজের হেমাটোলজিস্ট মহিউদ্দিন খান পর্যন্ত অনেকেই, যাকে কিনা মন্ত্রী পূর্বপরিকল্পনা মোতাবেক ডেকে এনেছিলেন। সবাই তাঁদের এই কথোপকথন উপভোগ করছেন। চলছে কথার পিঠে কথা। বিমলাংশু বললেন, ‘ঠিক আছে, এ রকম একটা কাজ হতে পারে, আর আমরাও সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে পারি, কিন্তু একটি শর্তে। এটা যেমন-তেমন একটা কেন্দ্র হলে চলবে না, একে হতে হবে সেন্টার অব এক্সেলেন্স। আর এখানে যাদের চিকিৎসা দেওয়া হবে, তাদের ঠিক ওইভাবে দেখতে হবে, যেমনটা আমরা আমাদের ইনস্টিটিউটে একজন মার্কিন নাগরিককে দেখি। মন্ত্রী সহাস্যে রাজি হলেন। এ জন্য যেকোনো সময়, যেকোনো দরকারে, যেকোনো পরিস্থিতিতে তাঁর জন্য যে মন্ত্রী মহোদয়ের ব্যক্তিগত সেল ফোন ও দরজা সব সময় খোলা থাকবে, তাও নিশ্চিত করলেন। তিনি এই কথা রেখেছিলেন। এভাবেই শুরু হয়ে গেল একটি মহৎ কাজ।
গত কয়েক বছরে ঢাকা মেডিকেলের চিকিৎসক, সেবিকা ও যন্ত্রকারিগরেরা এমজিএইচে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন বিষয়ে প্রশিক্ষণে গেছেন, কখনো বিদেশিরা এসে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এটাকে একটা আন্তর্জাতিক মানের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে  বিমলাংশু ছিলেন খানিকটা খুঁতখুঁতেও। কেন্দ্রটির স্থাপত্য ডিজাইন পর্যন্ত যেন এমজিএইচের মতোই হয়, সে জন্য প্রয়োজনে ওখানকার স্থপতিকে পর্যন্ত টেনে এনেছেন। ল্যাবরেটরির মান, স্টেম সেল সংগ্রহ, নার্সিং সাপোর্ট—যেকোনো কিছুতেই এটি আন্তর্জাতিক যেকোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতিযোগিতার সমকক্ষ। অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের মতো চিকিৎসা পেতে শুধু গরিব বা নিম্নমধ্যবিত্ত কেন, কারোরই আর বিদেশে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা নেই বলেই মনে করেন ডা. বিমলাংশু। তবে সরকার একা কত দিন এই বিপুল যজ্ঞ টেনে নিয়ে যেতে পারবে তা নিয়ে এখনই চিন্তা করার সময় এসেছে। সমাজের ধনী ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও উদ্যোক্তাদেরও এগিয়ে আসা উচিত বলে তিনি মনে করেন।
অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের জন্য আর বিদেশে যাওয়ার দরকার নেই বলে মনে করেন বিমলাংশু দেচোখের আলোয় দেখেছিলেমসিলেটের সন্তান বিমলাংশু রঞ্জন দে। ছাতকে জন্ম ও বেড়ে ওঠা। প্রথম পাঠ ছাতক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি স্কুলে, ১৯৭৫ সালে এসএসসি পাস করেন ওই স্কুল থেকেই। তারপর ’৭৭ সালে এইচএসসি সিলেটের মুরারী চাঁদ কলেজ থেকে।  চেয়েছিলেন গবেষক হতে, অঙ্ক ছিল প্রিয় বিষয়। তাই ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা বিভাগে। কিন্তু জীবন তাঁকে টেনে নিয়ে গেল অন্য দিকে। একটা বৃত্তি পেয়ে পড়তে গেলেন হাঙ্গেরির বুদাপেস্টে, বিষয় চিকিৎসাবিজ্ঞান। তার মানে কি চিকিৎসক হয়ে তিনি ভুল করেছেন বলে মনে হয়? মোটেই নয়। চিকিৎসক হতে পেরে তিনি সুখী ও তৃপ্ত। মনে হয় জীবন ঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছিল। এসএসসি ও এইচএসসিতে বোর্ডে দ্বিতীয় স্থান অধিকারী হওয়া বিমলাংশু মেধা ও প্রতিভার স্বাক্ষর রাখলেন হাঙ্গেরিতে গিয়েও, বরাবর চমৎকার ও সর্বোচ্চ স্কোর পাওয়ার কারণে গোল্ড মেডেল পান তিনি। আর এই স্কোরের রেকর্ড এখনো কেউ ভাঙতে পারেননি ওখানে। স্নাতক হওয়ার পর ইউরোপ ছেড়ে পাড়ি জমালেন যুক্তরাষ্ট্রে। পিএইচডি করলেন বোস্টনে, ট্রান্সপ্লান্টেশন ইমিউনোলজি বিষয়ে। হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালে যোগ দিলেন। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানের মেডিসিন ও অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন বিষয়ের বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করছেন। পাশাপাশি চালিয়ে যাচ্ছেন বেশ কিছু গবেষণাকাজ।
১৯৯৩ সালে মারা গেছেন বাবা সুকুমার চন্দ্র দে, যিনি ছিলেন অগাধ পাণ্ডিত্য আর জ্ঞানের অধিকারী, ছিলেন আজীবন  ছেলের কাছে এক বিরাট দার্শনিক ও গাইড। ছেলের রোল মডেল। বাবার বিরল ব্যক্তিত্বের ও পড়াশোনার পাশে চিরকালই মাকে মনে হতো খুবই ম্লান। কিন্তু ২০১০ সালে মা মনোরমা দের মৃত্যুর মোটে ছয় মাস আগে তিনি টের পান মা স্বল্পশিক্ষিতা হয়েও দারুণ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ একজন মানুষ। জ্ঞানের সঙ্গে যে লেখাপড়ার সম্পর্কটা আপেক্ষিক, এই সত্য বুঝতে পারেন আকস্মিকভাবে। যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে সংসার বিমলাংশু দের। ছেলে সমিত্র, মেয়ে প্রিয়ানা। আর স্ত্রী শর্বরী দেও সিলেটের মৌলভীবাজারের মেয়ে, রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন চমৎকার, আর গান বিমলাংশুর একটা প্রিয় বিষয়। গান শোনা ছাড়াও ছবি আঁকতে ভালোবাসতেন বিমল। আর ভালোবাসেন মানুষের সঙ্গে মিশতে, আড্ডা দিতে। নিজেকে একজন ভালো শ্রোতা মনে করেন তিনি, আর এজন্য তাঁর ভালো বন্ধুর অভাব নেই। বন্ধুর সংখ্যা দিন দিন তাই বাড়ছে, বাড়ছে এই বাংলাদেশেও। বন্ধুর হাত বাড়িয়ে আছেন আমাদের বিমলাংশু রঞ্জন দে, যিনি সেই কিরণ রশ্মি ছড়ানো হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উচ্চারণ করলেন শেষে রবীন্দ্রনাথকে—চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে...গানটা নাকি ভারি প্রিয় তাঁর।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চালু হয়েছে দেশের প্রথম অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন কেন্দ্রদেশের প্রথম অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন কেন্দ্রএই অক্টোবরেই উদ্বোধন হয়ে গেল দেশের একমাত্র ও প্রথম অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন কেন্দ্র, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এই কেন্দ্রের কারিগরি ও প্রশিক্ষণ সহায়তা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালের ক্যানসার সেন্টার। আর এই এমজিএইচের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের প্রধান যোগসূত্র হিসেবে কাজ করেছেন বাংলাদেশের সন্তান এমজিএইচ ক্যানসার সেন্টারের অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন বিশেষজ্ঞ ডা. বিমলাংশু রঞ্জন দে। অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের জন্য প্রায় প্রস্তুত এখন এই প্রতিষ্ঠানটি—জানালেন ডা. বিমলাংশু, সব ঠিক থাকলে ২০১৪ সালের জুলাই-আগস্টের মাঝেই শুরু হয়ে যাবে কাজ। সম্ভাব্য জটিলতা নিম্নতম রাখা ও নিরাপত্তার সূচক সর্বোচ্চ রাখাই প্রথম অগ্রাধিকার হিসেবে রাখছেন তাঁরা। অটোলোগাস স্টেম সেল বা নিজের অস্থিমজ্জা নিজের শরীরে প্রতিস্থাপন করার ক্ষেত্রে উন্নত বিশ্বে এখন মৃত্যুহার ১ শতাংশেরও নিচে, এই কেন্দ্রেও সেই মান বজায় রাখা হবে বলে বিশ্বাস তাঁর।    
-তানজিনা হোসেন
@ Prothom-alo