অথচ এই মানুষটির নাকি চিকিৎসক হওয়ারই কোনো পরিকল্পনা ছিল না। আর যখন হয়েও গেলেন, আর বিদেশে সুনাম কুড়ানোর পর দেশে কিছু করতে চাইলেন, তখনো অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন নিয়ে নাকি কোনো ভাবনাচিন্তা ছিল না। দেশে এসেছিলেন অন্য কাজে। অথচ জীবন কাকে দিয়ে কোন কাজটি করিয়ে নেবে বা নিতে চায়, তা বোঝা মুশকিল। কীভাবে এই বৃহৎ কর্মযজ্ঞের সঙ্গে তিনি একেবারে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়লেন, সে গল্প শুনতে হলে যেতে হবে একটু পেছনে, ২০০৬ সালে। ওই সময় থেকে তাঁর দেশে যাতায়াতের শুরু।
২০০৮ সালে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো একটা সফল আন্তর্জাতিক ক্যানসার সিম্পোজিয়াম অনুষ্ঠিত হয়েছিল, চিকিৎসক সমাজে অনেকেরই হয়তো মনে আছে সেটার কথা। বাংলাদেশে ক্যানসার চিকিৎসার পথিকৃৎ অধ্যাপক করিম বেঁচে ছিলেন তখনো। তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ও উদ্যোগে, সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টন থেকে আসা চিকিৎসক বিমলাংশু ও তাঁর সহকর্মীদের অংশগ্রহণে বেশ সফল হয়েছিল সিম্পোজিয়ামটি। ওটাই ছিল মূল অনুপ্রেরণা। তার পরপরই বিশ্বখ্যাত গাইনি অনকোলজিস্ট গুডম্যানের সঙ্গে বাংলাদেশে হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস টিকার একটা ট্রায়াল বা গবেষণাকাজে জড়িয়ে পড়েন তিনি। ৫০ জনকে নিয়ে দুই বছরের মাথায় এই ট্রায়ালটি সফলভাবে সমাপ্ত হয়। উৎসাহ-উদ্দীপনা বাড়ে। তাঁর মনে হতে থাকে যে বাংলাদেশেও আন্তর্জাতিক মানের গবেষণাকাজ সফলভাবেই করা সম্ভব। এই সময় তাঁর পরিচয় হয় চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী এ কে খানের সঙ্গে। অনেক কথা হয় দুজনের মধ্যে, অনেক ভাববিনিময় ও স্বপ্ন বিনিময়। ফলে ২০১০ সালে গড়ে ওঠে এ কে খান হেলথ কেয়ার ট্রাস্ট। এই ট্রাস্টের অধীনে বিমলাংশু দুটি প্রজেক্টে হাত দেন। এক. বাংলাদেশে নার্সিং সেবার মান উন্নতকরণ প্রকল্প। দুই. নারীদের জরায়ুমুখের ক্যানসার রোধে সচেতনতা, স্ক্রিনিং ও চিকিৎসা প্রকল্প। নার্সিং ব্রিজ প্রকল্পে বাংলাদেশের সেবিকাদের আন্তর্জাতিক মানের উন্নত সেবা দেওয়ার প্রশিক্ষণ দিতে বোস্টন থেকে আসেন জুডি ফস্টারসহ আরও অনেক স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব। আর তাঁর সঙ্গে কড়াইল বস্তিতে শুরু হয় নারীদের জরায়ুমুখ ক্যানসার রোধ, নির্ণয় ও চিকিৎসা প্রকল্পের কাজ। জোরেশোরে চলতে থাকে এসব প্রকল্প। নিজে তিনি একজন সফল অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন বিশেষজ্ঞ হলেও, সেদিকে নজর দেওয়ার তখন সময় ছিল না মোটেও। তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন এসব কাজে। এই কাজগুলো করতে গিয়ে সরকারের বিভিন্ন মহলে শুরু হলো তাঁর নিত্য যাতায়াত। এর তিন-চার মাস পর, এই কাজ নিয়ে কথা বলতে একদিন গেছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হকের কাছে। ঘটনার সূত্রপাত সেই দিনই।
স্বপ্নটা সবারই
মন্ত্রীও নাছোড়বান্দা—বেশ, তৈরি হতে কত দিন লাগতে পারে মনে হয়? যদি এখনই কাজে নামা যায়?
বিমলাংশু হাসেন সেদিনটির কথা মনে করে। সেদিন ওই ঘরটিতে আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন, তাঁর ম্যাসাচুসেটস জেনারেল হাসপাতালের ক্যানসার গবেষক দল থেকে শুরু করে ঢাকা মেডিকেল কলেজের হেমাটোলজিস্ট মহিউদ্দিন খান পর্যন্ত অনেকেই, যাকে কিনা মন্ত্রী পূর্বপরিকল্পনা মোতাবেক ডেকে এনেছিলেন। সবাই তাঁদের এই কথোপকথন উপভোগ করছেন। চলছে কথার পিঠে কথা। বিমলাংশু বললেন, ‘ঠিক আছে, এ রকম একটা কাজ হতে পারে, আর আমরাও সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে পারি, কিন্তু একটি শর্তে। এটা যেমন-তেমন একটা কেন্দ্র হলে চলবে না, একে হতে হবে সেন্টার অব এক্সেলেন্স। আর এখানে যাদের চিকিৎসা দেওয়া হবে, তাদের ঠিক ওইভাবে দেখতে হবে, যেমনটা আমরা আমাদের ইনস্টিটিউটে একজন মার্কিন নাগরিককে দেখি। মন্ত্রী সহাস্যে রাজি হলেন। এ জন্য যেকোনো সময়, যেকোনো দরকারে, যেকোনো পরিস্থিতিতে তাঁর জন্য যে মন্ত্রী মহোদয়ের ব্যক্তিগত সেল ফোন ও দরজা সব সময় খোলা থাকবে, তাও নিশ্চিত করলেন। তিনি এই কথা রেখেছিলেন। এভাবেই শুরু হয়ে গেল একটি মহৎ কাজ।
গত কয়েক বছরে ঢাকা মেডিকেলের চিকিৎসক, সেবিকা ও যন্ত্রকারিগরেরা এমজিএইচে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন বিষয়ে প্রশিক্ষণে গেছেন, কখনো বিদেশিরা এসে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এটাকে একটা আন্তর্জাতিক মানের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে বিমলাংশু ছিলেন খানিকটা খুঁতখুঁতেও। কেন্দ্রটির স্থাপত্য ডিজাইন পর্যন্ত যেন এমজিএইচের মতোই হয়, সে জন্য প্রয়োজনে ওখানকার স্থপতিকে পর্যন্ত টেনে এনেছেন। ল্যাবরেটরির মান, স্টেম সেল সংগ্রহ, নার্সিং সাপোর্ট—যেকোনো কিছুতেই এটি আন্তর্জাতিক যেকোনো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতিযোগিতার সমকক্ষ। অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের মতো চিকিৎসা পেতে শুধু গরিব বা নিম্নমধ্যবিত্ত কেন, কারোরই আর বিদেশে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা নেই বলেই মনে করেন ডা. বিমলাংশু। তবে সরকার একা কত দিন এই বিপুল যজ্ঞ টেনে নিয়ে যেতে পারবে তা নিয়ে এখনই চিন্তা করার সময় এসেছে। সমাজের ধনী ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও উদ্যোক্তাদেরও এগিয়ে আসা উচিত বলে তিনি মনে করেন।
১৯৯৩ সালে মারা গেছেন বাবা সুকুমার চন্দ্র দে, যিনি ছিলেন অগাধ পাণ্ডিত্য আর জ্ঞানের অধিকারী, ছিলেন আজীবন ছেলের কাছে এক বিরাট দার্শনিক ও গাইড। ছেলের রোল মডেল। বাবার বিরল ব্যক্তিত্বের ও পড়াশোনার পাশে চিরকালই মাকে মনে হতো খুবই ম্লান। কিন্তু ২০১০ সালে মা মনোরমা দের মৃত্যুর মোটে ছয় মাস আগে তিনি টের পান মা স্বল্পশিক্ষিতা হয়েও দারুণ জ্ঞান ও অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ একজন মানুষ। জ্ঞানের সঙ্গে যে লেখাপড়ার সম্পর্কটা আপেক্ষিক, এই সত্য বুঝতে পারেন আকস্মিকভাবে। যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে সংসার বিমলাংশু দের। ছেলে সমিত্র, মেয়ে প্রিয়ানা। আর স্ত্রী শর্বরী দেও সিলেটের মৌলভীবাজারের মেয়ে, রবীন্দ্রসংগীত গাইতেন চমৎকার, আর গান বিমলাংশুর একটা প্রিয় বিষয়। গান শোনা ছাড়াও ছবি আঁকতে ভালোবাসতেন বিমল। আর ভালোবাসেন মানুষের সঙ্গে মিশতে, আড্ডা দিতে। নিজেকে একজন ভালো শ্রোতা মনে করেন তিনি, আর এজন্য তাঁর ভালো বন্ধুর অভাব নেই। বন্ধুর সংখ্যা দিন দিন তাই বাড়ছে, বাড়ছে এই বাংলাদেশেও। বন্ধুর হাত বাড়িয়ে আছেন আমাদের বিমলাংশু রঞ্জন দে, যিনি সেই কিরণ রশ্মি ছড়ানো হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উচ্চারণ করলেন শেষে রবীন্দ্রনাথকে—চোখের আলোয় দেখেছিলেম চোখের বাহিরে...গানটা নাকি ভারি প্রিয় তাঁর।
|