Boxed Style

আইফোন জিতে ক্লিক করুন

Tuesday 4 November 2014

মাথাপিছু আয় কম হলেও সামাজিক সূচকে এগিয়ে ভারতকে ছাপিয়ে গেছে বাংলাদেশ

শওকত হোসেন | আপডেট: | প্রিন্ট সংস্করণ
সূত্র: বিশ্বব্যাংকসামাজিক প্রায় সব সূচকে ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। যদিও ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এখনো ৬০ শতাংশ কম। অথচ ১৯৭১ সালে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ সব ক্ষেত্রেই প্রতিবেশী দেশ ভারতের তুলনায় অনেক পিছিয়ে ছিল।
ভারতের মানুষ দ্বিগুণের বেশি আয় করলেও স্বাধীনতার ৪৩ বছর পর বাংলাদেশের মানুষ গড়ে তাদের তুলনায় তিন বছর বেশি বেঁচে থাকে। তবে ভারতের তুলনায় সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আছে মেয়েরা। ভারতের মেয়েদের তুলনায় বাংলাদেশের মেয়েদের শিক্ষার হার ৬ শতাংশ পয়েন্ট বেশি, নারীপ্রতি জন্মহারও দশমিক ৩ শতাংশ পয়েন্ট কম।
বিশ্বব্যাংক সম্প্রতি সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ ও ভারতের তুলনা করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ৫০ থেকে ৭০ ডলার। আর ভারতের ছিল ১১৬ ডলার। আর এখন ক্রয়ক্ষমতার সমতার (পিপিপি) ভিত্তিতে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় এক হাজার ৮৮৩ ডলার এবং ভারতের আয় তিন হাজার ৮৭৬ ডলার। সুতরাং, আয়ের দিক থেকে বড় ব্যবধান থেকে গেলেও সামাজিক সূচকে অনেকটাই এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গড় আয়ুষ্কাল ছিল মাত্র ৩৯ বছর, একই সময়ে ভারতের ছিল ৫০ বছর। আর এখন বাংলাদেশের মানুষ গড়ে বেঁচে থাকে ৬৯ বছর, ভারতে ৬৬ বছর। ১৯৭১ সালে প্রতি এক হাজারে ১৫০টি শিশুর মৃত্যু হতো, আর ভারতে ১১৪ জন। আর এখন বাংলাদেশে নবজাতকের মৃত্যুর হার ৩৭ জন, ভারতে ৪৪ জন। পাঁচ বছরের নিচে শিশু মৃত্যুর হার ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে ছিল হাজারে ২২৫ জন, ভারতে ১৬৬ জন। এখন বাংলাদেশে সেই সংখ্যা অনেক কমে হয়েছে ৪৬ জন, ভারতে ৬৫ জন।
বাংলাদেশের এই অগ্রগতির কারণ বর্ণনা করে ‘দেশ সহায়তা কৌশল অগ্রগতি’ নামের প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক বলেছে, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা, পরিবার পরিকল্পনা এবং লিঙ্গ সমতার বিষয়ে বাংলাদেশের সচেতনতা ও উদ্যোগের কারণে তা সম্ভব হয়েছে। আর এসব ক্ষেত্রে সহায়ক শক্তি ছিল মাঠপর্যায়ের কর্মী ও সংগঠকেরা, যাঁদের অধিকাংশই নারী। আর তাঁদের সমাবেশ ঘটিয়েছে সরকার, ব্র্যাকের মতো বিশ্বের প্রধান বেসরকারি সংস্থা ও গ্রামীণ ব্যাংকের নেতৃত্বে বিস্তৃত নেটওয়ার্কের ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলো।
নোবেল বিজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক অমর্ত্য সেন তাঁর নিজের দেশ ভারতের তুলনায় সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের এই সাফল্যের কথা বারবার লিখেছেন। তিনি তাঁর সর্বশেষ প্রকাশিত অ্যান আনসারটেইন গ্লোরি: ইন্ডিয়া অ্যান্ড ইটস কনট্রাডিকশনস বইয়ে ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের অগ্রগতি নিয়ে আলাদা একটি অধ্যায়ও রেখেছেন।
অথচ স্বাধীনতার পরপর বাংলাদেশের টিকে থাকা নিয়ে অনেকেরই সংশয় ছিল। সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার (তখন নিরাপত্তা উপদেষ্টা) স্বাধীনতার আগেই বাংলাদেশকে বলেছিলেন ‘ইন্টারন্যাশনাল বাস্কেট কেস’। অর্থাৎ বাংলাদেশকে একটি তলাবিহীন ঝুড়ির সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। স্বাধীন দেশে ১৯৭২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে প্রথম যে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করেছিল, সেখানে বাংলাদেশ নিয়ে হতাশার কথাই ছিল বেশি। বিশ্বব্যাংক বলেছিল, ‘সবচেয়ে ভালো পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশ একটি নাজুক ও জটিল উন্নয়ন সমস্যার নাম। দেশের মানুষেরা গরিব। মাথাপিছু আয় ৫০ থেকে ৭০ ডলার, যা গত ২০ বছরেও বাড়েনি। একটি অতি জনবহুল দেশ (প্রতি বর্গমাইলে জনসংখ্যা প্রায় এক হাজার ৪০০) এবং জনসংখ্যা আরও বাড়ছে (বছরে ৩ শতাংশ হারে জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধি) এবং দেশটির মানুষ অধিকাংশই নিরক্ষর (সাক্ষরতার হার ২০ শতাংশের কম)।’
বাংলাদেশ নিয়ে সেই বিশ্বব্যাংকেরই সর্বশেষ মূল্যায়ন হচ্ছে, বিশ্বের ৫ শতাংশ দরিদ্র মানুষের বাস হলেও ১৯৭১ সালে স্বাধীন হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশের অগ্রগতি প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশি। জনসংখ্যার ঘনত্বে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশটি বন্যা ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে নাজুক অবস্থার মধ্যে আছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এর নিত্যসঙ্গী, সঙ্গে আছে আন্তর্জাতিক বিশ্বের নানা ধরনের ধাক্কা, বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা দুর্বল এবং রাজনীতিও সংঘাতমুখর। তার পরও স্বাধীনতার পর থেকে প্রতি দশকে ১ শতাংশ হারে মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি বেড়েছে।
বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবে কি না, এ নিয়ে ব্যাপক সংশয় ছিল। এ কারণেই বাংলাদেশকে উন্নয়নের ‘টেস্ট কেস’ হিসেবে ধরা হতো। তার চার দশক পর এখন বাংলাদেশকে বরং উন্নয়নের বিস্ময় হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ থেকেই আমাদের আর্থসামাজিক অগ্রগতির ধারণা করা যায়।
আবার, স্বাধীনতার ঠিক পাঁচ বছর পর ১৯৭৬ সালে নরওয়ের অর্থনীতিবিদ জাস্ট ফ্যালান্ড এবং ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জে আর পারকিনশন বাংলাদেশ: দ্য টেস্ট কেস ফর ডেভেলপমেন্ট নামের একটি গবেষণামূলক বইয়ে লিখেছিলেন, ‘বাংলাদেশের পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে যদি এই দেশটি উন্নতি করতে পারে, তাহলে নিঃসন্দেহে বলা যায় পৃথিবীর যেকোনো দেশ উন্নতি করতে পারবে।’
২০০৭ সালে এ দুজনই আবার ‘বাংলাদেশ: দ্য টেস্ট কেস ফর ডেভেলপমেন্ট রিভিজিটেড’ নামের আরেক নিবন্ধে লিখলেন, ‘এ মুহূর্তে তিন দশক ও তার বেশি সময়ের সীমিত ও বর্ণাঢ্য অগ্রগতির ভিত্তিতে মনে হয় বাংলাদেশে টেকসই উন্নয়ন অর্জন সম্ভব, তবে এ সম্ভাবনা মোটেই নিশ্চিত নয়।’
বাংলাদেশ নিয়ে করা দুই অর্থনীতিবিদের ওই মূল্যায়নের পরে বাংলাদেশের গড় প্রবৃদ্ধি আরও বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবের ভিত্তিতে গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) বলছে, দেশে ২০০৭-০৯ সময়ে গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ দশমিক ৯৬ শতাংশ। আর এর পর থেকে ২০১৩-১৪ অর্থবছর পর্যন্ত সময়ে গড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ১৫ শতাংশ। অথচ এর আগে সত্তরের দশকে দেশের গড় প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ শতাংশ আর আশির দশকে ৪ শতাংশ।
সামগ্রিক পরিস্থিতিতে অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ প্রথম আলোকে বলেন, বাংলাদেশকে এখনো কিছু কিছু ক্ষেত্রে নতুন করে উন্নয়নের পরীক্ষাগার হিসেবে দেখা হচ্ছে। যেমন, বাংলাদেশের সামনে এখন চ্যালেঞ্জ হচ্ছে এত ঘনবসতিপূর্ণ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখে টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সুলভ শ্রমশক্তিকে কাজে লাগিয়ে রপ্তানিনির্ভর দ্রুতগতি ধরে রাখা, অর্থনৈতিক বৈষম্য সীমিত রেখে সামাজিক ভারসাম্য বজায় এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও গণতান্ত্রিক সুশাসনে একই সঙ্গে অগ্রগতির দৃষ্টান্ত তৈরি।