Boxed Style

আইফোন জিতে ক্লিক করুন

Wednesday 19 November 2014

বিশেষ সাক্ষাৎকার:সৈয়দা সাইয়িদান হামিদ সমন্বয়বাদী মানবতাবাদে ফিরতে হবে ভারতকে

ফারুক ওয়াসিফ | আপডেট: | প্রিন্ট সংস্করণ

ড. সৈয়দা সাইয়িদান হামিদড. সৈয়দা সাইয়িদান হামিদ ভারতের সাবেক পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে স্বাস্থ্য, নারী ও শিশু, সংখ্যালঘু অধিকার এবং ভারতের বেশ কটি রাজ্যের দায়িত্বে ছিলেন। বর্তমানে তিনি মাওলানা আজাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলরের পদে আসীন। নারী, ধর্মীয় ও সংখ্যালঘু অধিকার বিষয়ে
২০টির বেশি গ্রন্থের লেখক। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন ফারুক ওয়াসিফপ্রথম আলো  আপনি নারী ও সংখ্যালঘু সমস্যা নিয়ে কাজ করেছেন। ভারতের পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সদস্য হিসেবে নারীমুক্তির বেলায় আপনি বাংলাদেশের তুলনায় ভারতের অবস্থাকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
সৈয়দা হামিদ  আমি ১৯৯৭ সালে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে নারী প্রশ্নে খুবই সক্রিয় হই। এর আগেও নারী আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। সে সময় ভারতে নারী অধিকার প্রশ্নে অনেকে সোচ্চার ছিল। কিন্তু নারী-পুরুষ বৈষম্য সূচকে এখনো আমাদের অর্জন খুব ভালো নয়। মানব উন্নয়ন সূচকের ক্ষেত্রেও আমাদের আরও অনেক দূর যাওয়ার আছে। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, আমরা নারীদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে ভালো করেছি এবং ভারতের কিছু কিছু এলাকায় নারীশিক্ষায় উন্নতিও হয়েছে। তাহলেও নারীর প্রতি সহিংসতা এখনো বিরাট উদ্বেগের বিষয়। অন্যদিকে নারী-পুরুষ ভারসাম্যের অগ্রগতিও সাফল্যজনক নয়। নারীশিশুর ভ্রূণ হত্যাও বড় সমস্যা।
এককথায়, বাংলাদেশে যে সমস্যাগুলো বিরাজ করে, ভারতেও তা আছে। কিন্তু জনসংখ্যা অতিরিক্ত মাত্রায় বেশি হওয়ায় মাত্রাটা সেখানে অনেক বড়। দেশটা এত বড় আর পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা এতই গভীরভাবে প্রোথিত; তাই দরকার বিরাট উদ্যোগ। এ অবস্থা বদলানোয় পুরুষদেরও জড়িত করতে হবে। এর জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছাও প্রয়োজন।
প্রথম আলো  যখন সাম্প্রদায়িক ধর্মবাদী শক্তি সেই সমাজ ও রাজনীতিতে দাপটের সঙ্গে বিরাজ করে, তখন নারীর পক্ষে নিজের জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া আরও কঠিন হয়ে যায় নাকি?
সৈয়দা হামিদ  ভারত বা বাংলাদেশের সমাজ অতিমাত্রায় পিতৃতান্ত্রিক। এমনকি জেন্ডার-সূচকে শীর্ষে থাকা উত্তর ইউরোপীয় দেশগুলোতেও নারীর সংগ্রাম কাচের দেয়ালে ধাক্কা খাচ্ছে। এটাই হলো বাস্তবতা। কীভাবে এর থেকে বেরোব? ভারত ও বাংলাদেশের মতো দেশগুলো উন্নয়নের জন্য মরিয়া। আমরা চাইছি অবাধ বাণিজ্য, চাইছি বিপুল বিদেশি বিনিয়োগ, চাইছি শক্তিশালী অবকাঠামো। আমাদের অগ্রাধিকারে কেবলই প্রবৃদ্ধি গুরুত্ব পাচ্ছে, মানুষ নয়। তাই নারীর প্রতি পিতৃতান্ত্রিক বাধা অপসারণের চিন্তা আমরা করি না। কিন্তু নারীসহ সবার জন্য নিরাপদ ও আস্থাশীল পরিবেশ তৈরি করতে না পারলে কিছুই অর্জিত হবে না। আমি এটাকে কল্যাণবাদী দৃষ্টিতে দেখছি না। আমি বলছি, দেশের স্বার্থেই নারীর অবস্থানের উন্নতি দরকার। নারীর নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিত করাই সত্যিকার উন্নয়নের চাবিকাঠি। বিশ্ব যদি দেখে এখানকার সমাজ নারীর জন্য নিরাপদ ও সহায়ক, তাহলে তারা বুঝবে যে এখানে আইন ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা ভালো। সেটাই তাদের এখানে ব্যবসা ও বিনিয়োগে আগ্রহী করবে। ডান, বাম বা মধ্যপন্থী—যে ধরনের সরকারই ক্ষমতায় থাকুক, পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা নিয়ে তারা সমাজ বা অর্থনীতির উন্নতি করতে পারবে না।
প্রথম আলো  আইন বদলাচ্ছে, কিন্তু সমাজ সংস্কার করা হচ্ছে না। এভাবে কি অগ্রগতি সম্ভব?
সৈয়দা হামিদ ঠিক বলেছেন। যেমন যৌতুকের বিরুদ্ধে আমাদের দেশে আইন হয়েছে ১৯৪০-এর দশকে, কিন্তু এখনো যৌতুক রয়েছে। সুতরাং, কেবল আইন বদলানোয় উত্তর নেই, জনগণ ও সরকারের উপলব্ধি হতে হবে যে মানসিকতা না বদলালে তারা তাদের অর্থনৈতিক স্বপ্নও পূরণ করতে পারবে না। আমি যদি বউ পেটাই, তাহলে আমি খুলনা বা ছত্তিশগড় যেখানেই থাকি না কেন, আমি কিন্তু কোনো ক্ষেত্রেই দৃষ্টান্ত তৈরি করতে পারব না। তাই পুরুষদেরও নিজের স্বার্থেই নারীর প্রতি অবমাননাকর ও বঞ্চনামূলক মনোভঙ্গি ছাড়তে হবে।
প্রথম আলো আপনি গুজরাট গণহত্যা বিষয়ে বেসরকারি তদন্ত দলের একজন ছিলেন। যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি এখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। আপনার অনুভূতি কী?
সৈয়দা হামিদ  আমি সেই ঘটনার চাক্ষুষ সাক্ষী; আমি ছয়জনের দলের সদস্য হিসেবে সরেজমিনে ২০০২ সালের গুজরাট গণহত্যার তথ্য সংগ্রহে গিয়েছিলাম। কয়েক দিনের মধ্যেই গিয়েছিলাম।
আমি অনেক নির্যাতিতার সঙ্গে কথা বলেছি, যাঁদের ধর্ষণ করা হয়েছিল, ছিন্নভিন্ন করা হয়েছিল। এতই মর্মান্তিক যে পুনরুক্তি করাও কঠিন; আপনারা সবই জানেন। এই হত্যা-নির্যাতন যখন ঘটেছিল, তখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন আমাদের এখনকার প্রধানমন্ত্রী। রাজ্য সরকার দর্শকের ভূমিকায় অথবা সরাসরি আক্রমণে অংশ নিয়েছিল। এত মামলা আদালতে উঠেছিল! কিন্তু এগুলো গণমাধ্যমে ততটা মনোযোগ পায়নি। আমি এসব কখনোই ভুলতে পারব না, কারণ আমি নিজে এসবের সাক্ষী ছিলাম। কিন্তু দেশবাসী সেই বিশেষ রাজনৈতিক দলকে ভোট দিয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা দিয়েছে। দেখা যাক, তারা কী করে?
দেখুন, আজ পর্যন্ত কংগ্রেসকে ১৯৮৪ সালের শিখ গণহত্যার অভিযোগের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হচ্ছে। তারা এখনো মুক্তি পায়নি। বিজেপিকেও ২০০২ সালের মুসলিম হত্যার অভিযোগ তাড়া করে বেড়াবে। এখন পর্যন্ত হিটলারের ইহুদি নিধনের কথা মানুষ আলোচনা করে। মানুষ কি কখনো এসব ভুলে যাবে? এটা এমন এক অলঙ্ঘনীয় বাস্তবতা! যখন ক্ষতগুলোর শুশ্রূষা হবে, ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে, বিচার হবে, যখন শত প্রচেষ্টার মধ্যে দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের জীবন আবার স্বাভাবিক হবে, তখন হয়তো আমরা বিষয়টার দিকে সম্পূর্ণভাবে তাকাতে পারব।
প্রথম আলো  ইতিহাস দেখায়, উপমহাদেশের বৃহৎ দেশ হিসেবে ভারতের রাজনৈতিক গতিধারার প্রভাব বাংলাদেশের মতো দেশেও পড়ে। আপনি কি মনে করেন বিজেপি-শাসিত ভারত বাংলাদেশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, ‘হিন্দুত্ব’ভীতি সৃষ্টি করবে এবং বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জীবনও অশান্ত হবে?
সৈয়দা হামিদ  আপনি ঠিকই বলেছেন, ভারতে যা-ই ঘটে, তার আঞ্চলিক প্রভাব রয়েছে। ভারতে সংখ্যালঘু নির্যাতন হলে অন্যান্য দেশের সংখ্যালঘুরাও অনিরাপদ হয়ে পড়ে। যেমন: সম্প্রতি মুজাফফরনগরে সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে, উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্রসহ অনেক রাজ্যেই বেশ কিছু সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে। এটা একটা বিষয়। আরেকটা বিষয় হলো, সব সময় নির্বাচনের আগে সম্প্রদায়ভিত্তিক মেরুকরণের স্বার্থে এসব ঘটানো হয়। যারা করে তারা খুবই অদূরদর্শী। ভারতের সৌন্দর্যই হলো এখানে বহু জাতি-ধর্মের মিলন হয়েছে। আমরা একে বলি গঙ্গা-যমুনা সংস্কৃতি, দুটি নদীর সঙ্গমস্থলের মিলনের সংস্কৃতি। এখানে অনেকগুলো ধর্ম ও সংস্কৃতি বিকশিত হয়েছে, যেন অনেক পাপড়ির একটি ফুল ফুটেছে। ভারত হলো বহু সংস্কৃতির মিলনক্ষেত্র—আমেরিকাকে যেমন বলা হয় মেল্টিংপট। এটা ঠিক পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মতো নয়। যখনই ভারতের সব ভিন্নতাকে পিষে একাকার করা হবে, তখনই দেশটির সামাজিক বুনন ছিঁড়ে যাবে। এ জন্যই সরকারকে এ বিষয়ে খুবই যত্নবান হতে হবে। এটা শুরু করতে হবে বিদ্যালয় থেকে। শিশুদের সামাজিকায়ন, শিক্ষায়নকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে হবে। যখন বাংলাদেশে বা ভারতের পাঠ্যপুস্তকে শুধু এক ধর্মের মানুষকে ভালোবাসতে শেখানো হয়, এক ধর্মের দেশের ধারণা দেওয়া হয়, তখন শিশুরা তো ভুল চিন্তা নিয়ে বেড়ে উঠবেই। তারা তো তাদের প্রতিবেশীদের সম্পর্কে কিছুই জানে না। আপনি যদি সুশাসন চান, গণতন্ত্র চান, সত্যিকার উন্নয়ন চান, তাহলে আপনাকে সহনশীল সহাবস্থানের পথে আসতেই হবে।
প্রথম আলো  আপনি কিংবদন্তিতুল্য চলচ্চিত্রকার খাজা আহমেদ আব্বাসের ভাগনি এবং বিখ্যাত কবি মাওলানা আলতাফ হোসেন হালির কন্যার নাতনি। তাঁদের মাধ্যমে ভারতবর্ষে সমন্বয়ী মানবতাবাদের ঐতিহ্য এগিয়ে গিয়েছিল। আপনি কি মনে করেন সেই ঐতিহ্য আজ হুমকির মুখে?
সৈয়দা হামিদ  আমি আশাবাদী, কারণ সেই মানবতাবাদ ছাড়া ভারতকে কল্পনা করা যায় না। মাওলানা হালি ১২০ বছর আগে নারীশিশুর গুরুত্ব নিয়ে লিখেছিলেন, তিনি বিধবাদের দুঃখ নিয়ে লিখেছেন, নারীর পক্ষে লিখেছেন। তিনি সেই ইসলামকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন, যে ইসলাম হিন্দু-মুসলিম-শিখ—সবাইকে আলিঙ্গন করে। তাঁরা ইসলামের খুবই মানবতাবাদী বয়ানে বিশ্বাসী ছিলেন।
প্রথম আলো তাঁরা ইনসানিয়াতের কথা বলতেন।
সৈয়দা হামিদ  হ্যাঁ, ইনসানিয়াতই ইসলামি মানবতাবাদ। খাজা আব্বাস নকশালবাড়ি আন্দোলন নিয়ে প্রথম চলচ্চিত্র তৈরি করেছিলেন, যেখানে মিঠুন চক্রবর্তী প্রথম অভিনয় করেন, আরও ছিলেন স্মিতা পাতিল। তিনি বাংলার ৪৩-এর দুর্ভিক্ষ নিয়ে ধরতি কি লাল চলচ্চিত্র তৈরি করেছেন। সে সময় তিনি বলেছিলেন যে, এই দুর্ভিক্ষের শিশুরা বড় হয়ে বিদ্রোহী হবে এবং সত্যিই সেটা ঘটেছিল নকশাল আন্দোলনে। তিনি জনপ্রিয় মুম্বাই চলচ্চিত্রে সাম্প্রদায়িক মিলনের মাধ্যমে নিপীড়িত মানুষের শক্তিকে প্রকাশ করেছেন। তিনি আদর্শবাদী লেখকও ছিলেন। ৪৫ বছর যাবৎ ব্লিৎস পত্রিকায় অসম্ভব জনপ্রিয় কলাম লিখে গেছেন। তিনি দরিদ্র ছিলেন, কেননা আদর্শবাদে আস্থা ছিল তাঁর। তাঁর আদর্শবাদে হিন্দু-মুসলিম সবার আসন ছিল, ঠিক যেমনটা ভাবতেন কংগ্রেস সভাপতি এবং ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী মাওলানা আবুল কালাম আজাদ। আমি মনে করি, হিন্দু-মুসলিমনির্বিশেষে জাতীয় স্বার্থেই আমাদের এই সমন্বয়বাদী মানবতাবাদে ফিরতে হবে।
প্রথম আলো আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।
সৈয়দা হামিদ  আপনাকেও ধন্যবাদ।