Boxed Style

আইফোন জিতে ক্লিক করুন

Saturday 1 February 2014

স্মরণ শোনো বন্ধু শোনো

মতিন রহমান | আপডেট: ০০:২০, জানুয়ারি ৩০, ২০১৪ | প্রিন্ট সংস্করণ
মহম্মদ হান্নানবন্ধু, তুমি তোমরা মিলে চালু করেছিলে প্রবীণ চিত্রপরিচালকদের আড্ডা ও পারিবারিক ভোজ। যে ভোজে যে আড্ডায় আজও চিত্রপরিচালক সমিতি গল্প-কলরবে মুখর। ২৪ জানুয়ারি ছিল বন্ধু তোমাকে নিয়েই আড্ডা ও স্মৃতিচারণা সভা।
সভাটি শুরু হয় বিকেল তিনটায় জহির রায়হান কালার ল্যাব প্রজেকশন হলে। শুরুতে মাইক হাতে নিয়ে কাজী হায়াৎ উচ্চারণ করলেন, ‘মহম্মদ হান্নান ছিল তার সব সংকটে জেগে থাকা যুবক কলম্বাস। আমার কলম্বাসকে আমি ভুলব কেমন করে?’ কাজী হায়াতের দরাজ কণ্ঠের আবেগমিশ্রিত বক্তব্যের পর মঞ্চে দাঁড়িয়ে আমি বললাম, ‘হান্নানের জানাজা, আজকের এই স্মৃতিচারণা সভায় স্বল্পজনের উপস্থিতি আমাকে পীড়া দিচ্ছে। প্রশ্নের সামনে দাঁড় করাচ্ছে। কোথায় গেল আমাদের সিনেমার ঐতিহ্যগত এক পরিষ্কার ভাবনা? একে অন্যের ব্যথা-ভাবনায় আবেগ নিয়ে ছুটে আসা। বন্ধু হান্নানের জানাজায় কোথায় ছিল হান্নানের সিনেমাপুত্র, যাকে হান্নান বন থেকে তুলে এনে বাগানের শোভা দান করেছিল?’
আমার অভিমানটা হালকা করে দিতে আমজাদ হোসেন বললেন, ‘এই এফডিসি ছিল আমাদের ঘর গেরস্থালি। আজ আমাদের এফডিসিই বিপন্নের মুখে। সেখানে এক কৃষকের মৃত্যুতে শোকসভা কী করে গমগম করে উঠবে?’
শোনো বন্ধু হান্নান,
বেদনা নিয়ো না। তোমার প্রিয় শিক্ষক আমজাদ হোসেন তোমার চিরবিদায়কালে তোমার স্থির মুখচ্ছবিটি দেখেননি। মনকে প্রবোধ দিয়ে রেখেছেন, তুমি আছ। তাঁর কাছে আছ। হঠাৎ শত মানুষের ভিড়ে তোমার মুখটা দেখবেন, প্রশ্ন করবেন: হান্নান, এত দিন কোথায় ছিলে?
তোমার অনুজ মোহাম্মদ হোসেন জেমী দায়িত্ব নিয়েছেন তোমার শেষ লেখা আমাদের আমজাদ হোসেন ২০১৪ একুশের বইমেলায় পাঠকের হাতে পৌঁছে দেবেই। তোমার কবিতা, সাহিত্য প্রেম বাঁচিয়ে রাখতে তোমার নামকরণে পরিচালক সমিতি সাহিত্য পুরস্কারও ঘোষণা করবে। মহম্মদ হান্নানকে নিয়ে স্মৃতিচারণা অনুষ্ঠানে যখন ভাবাবেগ ও অঙ্গীকার ঘোষিত হচ্ছিল, ঠিক তখনই হান্নানের লেখা প্রকাশিতব্য বইটির ভূমিকা পাঠ করলেন মুশফিকুর রহমান গুলজার, যা শুনে হঠাৎই আমাদের মনে হয়েছিল, এতক্ষণ তোমাকে নিয়ে বলা সব কথা তুমি অনন্তপারে বসেই শুনতে পেরেছ। তড়িঘড়ি একটি জবাবও লিখে পাঠিয়েছ।
‘আমি কোনো স্মৃতিচারণা উৎসবে বিশ্বাস করি না। স্মৃতিচারণায় বক্তার বক্তব্যে মর্ত্যের চেয়ে কিছু সাজানো সত্য থাকে। নষ্টজনকেও কখনো উদার সিংহাসনে কীর্তিময় পুরুষ হিসেবে বর্ণনা করা হয়। আর প্রয়াতজনের উদ্দেশে রাখা হয় চমকানো সব আশ্বাস, অঙ্গীকার। মানুষকে নিয়ে মূল্যায়ন অথবা যা কিছু যদি করার থাকে, তার জীবদ্দশায় করা উচিত। তাই আমি আমাদের আমজাদ হোসেন নামে একটি জীবনগল্প রচনা করেছি।’
বেঁচে থাকতে তোমার নিজ হাতে লিখে যাওয়া এতটুকু ভূমিকা বক্তব্যে স্মৃতিচারণা অনুষ্ঠানে আসা সবাই বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। একেই বলে কাকতালীয় ঘটনা। কী আশ্চর্য ঘটনা। তুমি যে জীবিত মানুষের জন্য ভূমিকাটি লিখেছিলে, বেঁচে থাকতেই তাঁর স্বীকৃতি দিতে চেয়েছিলে, সেই বেঁচে থাকা মানুষ আমজাদ হোসেন জলভেজা চোখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছেন, আর তাঁকে তুমি কিছু না বলে পরপারে চলে গেলে?
সোহানুর রহমান বললেন, ‘আমাদের হান্নান ভাই চলে যাননি। তিনি আছেন বরিশালের করাপুর গ্রামে। তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে এখন থেকে আমাদের করাপুর গ্রামে যেতে হবে।’ কী চমৎকার সংলাপে তোমাকে স্মরণ করেছিলেন সোহান।
বন্ধু, তোমাকে নিয়ে আরও কিছু স্মৃতিকথা শুনতে চাও? শোনো তাহলে, তোমাকে নিয়ে চাষী নজরুল ইসলাম কী বলছেন, ‘আমাকে না বলে হান্নানের যাওয়ার কথা ছিল না। ও আমাকে কথা দিয়েছিল, আমার মরদেহ কাঁধে করে আমার গ্রাম বিক্রমপুর রেখে আসবে। এমনই তো কথা ছিল। কেউ কথা রাখে না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় প্রিয় হান্নানও কথা রাখতে পারেনি।’
এত শক্ত মনের মানুষ শ্রেষ্ঠ অ্যাকশন নির্মাতা, পরিচালক সমিতির বর্তমান সভাপতি শহীদুল ইসলাম খোকন তোমার স্মৃতিচারণা অনুষ্ঠানে সারাক্ষণ বোবা কান্না কেঁদেছেন। কেঁদেছেন সাইদুর রহমান, এম এ হক অলিক, রেজা হাসমত, নাজমূল হুদা মিন্টু, আবুল কালাম আযাদ, বজলুর রাশেদ, সেলিমসহ আরও বহুজন।
বন্ধু শোনো, তুমি আছ। এ বিশ্বাস নিয়েই আমরা বেঁচে থাকব।
 লেখক: চলচ্চিত্র নির্মাতা