আপডেট: ০০:৩৮, জানুয়ারি ৩০, ২০১৪
| প্রিন্ট সংস্করণ
|
সে বহুকাল আগের কথা।
বিখ্যাত ব্রিটিশ নির্মাতা টিম পোপ একটা বিজ্ঞাপন বানাবেন। বাচ্চাদের খাবারের বিজ্ঞাপন। একটা মেয়ে দরকার। ১০ থেকে ১২ বছর বয়স। কাজটা সহজ নয়। বিশেষ করে বাচ্চাদের নিয়ে কাজ করার অতীত অভিজ্ঞতা পোপের সুখকর নয়। এর আগে এমন একটা কাজ করতে গিয়ে মাথার চুল অর্ধেক হারিয়েছেন। পোপের আশঙ্কা, এবার বাকি চুলগুলোর শ্রাদ্ধ হয়ে যাবে। মাথাটাকে এরপর স্টেডিয়াম হিসেবে ভাড়া দিতে পারবেন, ‘সুবিধা’ বলতে এই একটাই।
পোপের সহকারীরা খুঁজে খুঁজে হয়রান। অবশেষে একটা মেয়ের সন্ধান মিলল। বার্কশায়ারের রেডরুফস থিয়েটার স্কুলে পড়ে একটা মেয়ে। ১১ বছর বয়স। মেয়েটার সঙ্গে কাজ করার পর পোপ রায় দিলেন, ‘এই মেয়ের থিয়েটার স্কুলে পড়ে কোনো লাভ হবে না। বেকার সময় নষ্ট। কারণ, থিয়েটার স্কুল ওকে যা শেখাবে, সেটা যে জন্ম থেকেই শিখে এসেছে!’
মেয়েটার বংশপরিচয়ের ঠিকুজি জানলে পোপ হয়তো চমকাতেন না। ইংল্যান্ডের এক ‘থেস্পিয়ান’ পরিবারে জন্ম। মানে কিনা এমন এক পরিবার, যে পরিবারের সদস্যরা তো বটেই, বাড়ির আসবাবপত্র, হাঁড়িপাতিলও অভিনয়ে ওস্তাদ! বাবা রজার উইন্সলেট আর মা স্যালি ব্রিজেস দুজনই ছিলেন মঞ্চশিল্পী। নানা-নানি দুজনই একসময় রিডিং রেপার্টরি থিয়েটার চালাতেন। মামা লন্ডনের ওয়েস্ট অ্যান্ড থিয়েটারের নিয়মিত শিল্পী ছিলেন। সেই পরিবারের মেয়ে কেট উইন্সলেট।
উইন্সলেটকে বোঝাতে সব সময় তাঁর বাড়ির ট্রফি রাখার শোকেসটার দিকে তাকাতে বলা হয়। যেখানে কী নেই? একাডেমি অ্যাওয়ার্ড ওরফে অস্কার, গোল্ডেন গ্লোব, বাফটা, এমি, গ্র্যামি, ক্রিটিক চয়েস, স্ক্রিন অ্যাক্টর গিল্ডস, সিজার অ্যাওয়ার্ড—একজন অভিনয়শিল্পীর যত পুরস্কার পাওয়া সম্ভব, তার চেয়ে বেশিই পেয়েছেন। যেমন গ্র্যামি কি আর সব অভিনেতার কপালে জোটে?
এবারও গোল্ডেন গ্লোবে মনোনয়ন পেয়েছিলেন। অস্কারের পর সম্ভবত সবচেয়ে সম্মানজনক এই পুরস্কারে মনোনয়ন পাওয়া তাঁর জন্য ডালভাত। দশ-দশবার মনোনয়ন পেয়েছেন গোল্ডেন গ্লোবে। এবার শেষ পর্যন্ত জেতেননি, জিতলে সংখ্যাটা হতো চার। একবার মাত্র অস্কার জিতলেও মনোনয়ন পেয়েছেন ছয়-ছয়বার। তিনিই ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সে সবচেয়ে বেশিবার অস্কার মনোনয়ন পাওয়া শিল্পী।
এই সাফল্যের খুবই সরল একটা সূত্র আছে। সেটা হলো, সাফল্যের নিশ্চিত মখমল বিছানো পথে না হাঁটা। এর চেয়ে চ্যালেঞ্জ তুলে নেওয়া বারবার। এ কারণেই আমরা দেখি, ১৯৯৭ সালে টাইটানিক-এর পর তাঁর খ্যাতি যখন আকাশছোঁয়া, সে সময়ও তিনি ইংল্যান্ডের পাততাড়ি গুটিয়ে হলিউডের স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার প্রলোভনে ভুললেন না। অসাধারণ সব গ্ল্যামার উপচানো চরিত্রের প্রস্তাব ফেলে বেছে নিতে লাগলেন ছোট অফবিট ধাঁচের চরিত্র। যেমন হিডিয়াস কিঙ্কি, যেখানে অভিনয় করলেন হিপ্পি মায়ের চরিত্রে। কুইলস বা আইরিস-এর মতো চ্যালেঞ্জিং সব ছবি। সেই ধারাবাহিকতায় এল ইটারনাল সানশাইন অব দ্য স্পটলেস মাইন্ড, ফাইন্ডিং নেভারল্যান্ড, লিটল চিলড্রেন, দ্য রিডার, রেভ্যলিউশনারি রোড ও কার্নেজ।
অভিনেতাদের হতে হয় মাটির সেই মণ্ডের মতো। পেলব, নমনীয়—যেকোনো আকার ধারণ করা যার পক্ষে সম্ভব। নিয়তই নিজেকে ভাঙচুর করার নেশায় মেতে ওঠা উইন্সলেট এবার অভিনয় করেছেন লেবার ডে ছবিতে। ১৯৮৭ সালের প্রেক্ষাপটে নির্মিত অ্যাডেলে হুইলার নামের এক সিঙ্গেল মাদারের চরিত্রে। আগামীকাল মুক্তি পাচ্ছে ছবিটি।
তারকা হয়েও তাই শেষ পর্যন্ত তারকার খোলসে তিনি বন্দী নন। টাইটানিক তাঁকে শিখিয়েছে, উত্তাল কিংবা হিমশীতল সাগরে ভেসে থাকতে চাইলে ছোট্ট একটা অবলম্বন হলেও চলে। টাইটানিক তাঁকে শিখিয়েছে, জীবন মানে আসলে আত্মদান, স্যাক্রিফাইস। টাইটানিক করার আগে যে ছোট্ট বাড়িটায় থাকতেন, টাইটানিক-সাফল্যের পরও ফিরে গেছেন সেখানেই। ‘ছবিটা অসম্ভব সাফল্য পেয়েছে মানেই এই নয় আমি হুট করে উত্তর লন্ডনের আমার ছোট্ট বাড়িটার শিকড় উপড়ে ফেলে লস অ্যাঞ্জেলেসে ৬০ লাখ পাউন্ড দামের প্রাসাদে গিয়ে উঠব’—সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন এই ৩৮ বছর বয়সী।
টাইটানিক সাফল্যের পরও কেন নিজের শিকড়ে থেকে গিয়েছিলেন, তার আরও বিশদ ব্যাখ্যাও দিয়েছেন, ‘বিখ্যাত সফল পরিপূর্ণ শিল্পীজীবনের জন্য আমি তখন প্রস্তুতই ছিলাম না। আমার বয়স ছিল মাত্র ২১। জানতাম, অভিনয়শিল্পী হিসেবে আমি পরিপূর্ণ নই। আমার এখনো অনেক শেখার বাকি।’
সেই শেখাটা তিনি এখনো শিখছেন বলেই দাবি করলেন, ‘আমার কাজ একজন চলচ্চিত্র তারকার নয়, আমার কাজ একজন অভিনয়শিল্পীর। প্রতিটি ছবিকেই আমি আমার নিজের প্রথম ছবি হিসেবেই দেখেছি। এখনো সেই একই অনুভূতিই হয়, সেই একই আনন্দ।’
এ কারণেই হয়তো তাঁর ফেসবুক-টুইটার নেই। এ কারণেই হয়তো তিনি ‘সেকেলে’। এ কারণেই হয়তো তিনি অন্য রকম। তিনি অনন্যা!
রাজীব হাসান
হলিউড রিপোর্টার অবলম্বনে
বিখ্যাত ব্রিটিশ নির্মাতা টিম পোপ একটা বিজ্ঞাপন বানাবেন। বাচ্চাদের খাবারের বিজ্ঞাপন। একটা মেয়ে দরকার। ১০ থেকে ১২ বছর বয়স। কাজটা সহজ নয়। বিশেষ করে বাচ্চাদের নিয়ে কাজ করার অতীত অভিজ্ঞতা পোপের সুখকর নয়। এর আগে এমন একটা কাজ করতে গিয়ে মাথার চুল অর্ধেক হারিয়েছেন। পোপের আশঙ্কা, এবার বাকি চুলগুলোর শ্রাদ্ধ হয়ে যাবে। মাথাটাকে এরপর স্টেডিয়াম হিসেবে ভাড়া দিতে পারবেন, ‘সুবিধা’ বলতে এই একটাই।
পোপের সহকারীরা খুঁজে খুঁজে হয়রান। অবশেষে একটা মেয়ের সন্ধান মিলল। বার্কশায়ারের রেডরুফস থিয়েটার স্কুলে পড়ে একটা মেয়ে। ১১ বছর বয়স। মেয়েটার সঙ্গে কাজ করার পর পোপ রায় দিলেন, ‘এই মেয়ের থিয়েটার স্কুলে পড়ে কোনো লাভ হবে না। বেকার সময় নষ্ট। কারণ, থিয়েটার স্কুল ওকে যা শেখাবে, সেটা যে জন্ম থেকেই শিখে এসেছে!’
মেয়েটার বংশপরিচয়ের ঠিকুজি জানলে পোপ হয়তো চমকাতেন না। ইংল্যান্ডের এক ‘থেস্পিয়ান’ পরিবারে জন্ম। মানে কিনা এমন এক পরিবার, যে পরিবারের সদস্যরা তো বটেই, বাড়ির আসবাবপত্র, হাঁড়িপাতিলও অভিনয়ে ওস্তাদ! বাবা রজার উইন্সলেট আর মা স্যালি ব্রিজেস দুজনই ছিলেন মঞ্চশিল্পী। নানা-নানি দুজনই একসময় রিডিং রেপার্টরি থিয়েটার চালাতেন। মামা লন্ডনের ওয়েস্ট অ্যান্ড থিয়েটারের নিয়মিত শিল্পী ছিলেন। সেই পরিবারের মেয়ে কেট উইন্সলেট।
উইন্সলেটকে বোঝাতে সব সময় তাঁর বাড়ির ট্রফি রাখার শোকেসটার দিকে তাকাতে বলা হয়। যেখানে কী নেই? একাডেমি অ্যাওয়ার্ড ওরফে অস্কার, গোল্ডেন গ্লোব, বাফটা, এমি, গ্র্যামি, ক্রিটিক চয়েস, স্ক্রিন অ্যাক্টর গিল্ডস, সিজার অ্যাওয়ার্ড—একজন অভিনয়শিল্পীর যত পুরস্কার পাওয়া সম্ভব, তার চেয়ে বেশিই পেয়েছেন। যেমন গ্র্যামি কি আর সব অভিনেতার কপালে জোটে?
এবারও গোল্ডেন গ্লোবে মনোনয়ন পেয়েছিলেন। অস্কারের পর সম্ভবত সবচেয়ে সম্মানজনক এই পুরস্কারে মনোনয়ন পাওয়া তাঁর জন্য ডালভাত। দশ-দশবার মনোনয়ন পেয়েছেন গোল্ডেন গ্লোবে। এবার শেষ পর্যন্ত জেতেননি, জিতলে সংখ্যাটা হতো চার। একবার মাত্র অস্কার জিতলেও মনোনয়ন পেয়েছেন ছয়-ছয়বার। তিনিই ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সে সবচেয়ে বেশিবার অস্কার মনোনয়ন পাওয়া শিল্পী।
এই সাফল্যের খুবই সরল একটা সূত্র আছে। সেটা হলো, সাফল্যের নিশ্চিত মখমল বিছানো পথে না হাঁটা। এর চেয়ে চ্যালেঞ্জ তুলে নেওয়া বারবার। এ কারণেই আমরা দেখি, ১৯৯৭ সালে টাইটানিক-এর পর তাঁর খ্যাতি যখন আকাশছোঁয়া, সে সময়ও তিনি ইংল্যান্ডের পাততাড়ি গুটিয়ে হলিউডের স্থায়ী বাসিন্দা হওয়ার প্রলোভনে ভুললেন না। অসাধারণ সব গ্ল্যামার উপচানো চরিত্রের প্রস্তাব ফেলে বেছে নিতে লাগলেন ছোট অফবিট ধাঁচের চরিত্র। যেমন হিডিয়াস কিঙ্কি, যেখানে অভিনয় করলেন হিপ্পি মায়ের চরিত্রে। কুইলস বা আইরিস-এর মতো চ্যালেঞ্জিং সব ছবি। সেই ধারাবাহিকতায় এল ইটারনাল সানশাইন অব দ্য স্পটলেস মাইন্ড, ফাইন্ডিং নেভারল্যান্ড, লিটল চিলড্রেন, দ্য রিডার, রেভ্যলিউশনারি রোড ও কার্নেজ।
অভিনেতাদের হতে হয় মাটির সেই মণ্ডের মতো। পেলব, নমনীয়—যেকোনো আকার ধারণ করা যার পক্ষে সম্ভব। নিয়তই নিজেকে ভাঙচুর করার নেশায় মেতে ওঠা উইন্সলেট এবার অভিনয় করেছেন লেবার ডে ছবিতে। ১৯৮৭ সালের প্রেক্ষাপটে নির্মিত অ্যাডেলে হুইলার নামের এক সিঙ্গেল মাদারের চরিত্রে। আগামীকাল মুক্তি পাচ্ছে ছবিটি।
তারকা হয়েও তাই শেষ পর্যন্ত তারকার খোলসে তিনি বন্দী নন। টাইটানিক তাঁকে শিখিয়েছে, উত্তাল কিংবা হিমশীতল সাগরে ভেসে থাকতে চাইলে ছোট্ট একটা অবলম্বন হলেও চলে। টাইটানিক তাঁকে শিখিয়েছে, জীবন মানে আসলে আত্মদান, স্যাক্রিফাইস। টাইটানিক করার আগে যে ছোট্ট বাড়িটায় থাকতেন, টাইটানিক-সাফল্যের পরও ফিরে গেছেন সেখানেই। ‘ছবিটা অসম্ভব সাফল্য পেয়েছে মানেই এই নয় আমি হুট করে উত্তর লন্ডনের আমার ছোট্ট বাড়িটার শিকড় উপড়ে ফেলে লস অ্যাঞ্জেলেসে ৬০ লাখ পাউন্ড দামের প্রাসাদে গিয়ে উঠব’—সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে বলেছেন এই ৩৮ বছর বয়সী।
টাইটানিক সাফল্যের পরও কেন নিজের শিকড়ে থেকে গিয়েছিলেন, তার আরও বিশদ ব্যাখ্যাও দিয়েছেন, ‘বিখ্যাত সফল পরিপূর্ণ শিল্পীজীবনের জন্য আমি তখন প্রস্তুতই ছিলাম না। আমার বয়স ছিল মাত্র ২১। জানতাম, অভিনয়শিল্পী হিসেবে আমি পরিপূর্ণ নই। আমার এখনো অনেক শেখার বাকি।’
সেই শেখাটা তিনি এখনো শিখছেন বলেই দাবি করলেন, ‘আমার কাজ একজন চলচ্চিত্র তারকার নয়, আমার কাজ একজন অভিনয়শিল্পীর। প্রতিটি ছবিকেই আমি আমার নিজের প্রথম ছবি হিসেবেই দেখেছি। এখনো সেই একই অনুভূতিই হয়, সেই একই আনন্দ।’
এ কারণেই হয়তো তাঁর ফেসবুক-টুইটার নেই। এ কারণেই হয়তো তিনি ‘সেকেলে’। এ কারণেই হয়তো তিনি অন্য রকম। তিনি অনন্যা!
রাজীব হাসান
হলিউড রিপোর্টার অবলম্বনে