ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সি, বিশেষ করে তার 'আমেরিকা ফার্স্ট' নীতির অধীনে, যুক্তরাষ্ট্রের চিরাচরিত পররাষ্ট্রনীতিতে এক গভীর পরিবর্তন এনেছে। বিশ্বব্যাপী আমেরিকার নেতৃত্ব, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং বিভিন্ন জোটের প্রতি ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি প্রচলিত ধারণার বাইরে গিয়ে নতুন এক ধারার জন্ম দিয়েছে। তার দ্বিতীয় মেয়াদের সম্ভাবনা বিশ্বজুড়ে ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক, রাষ্ট্রনেতা এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে অসংখ্য প্রশ্ন ও অনিশ্চয়তা তৈরি করেছে। এই প্রবন্ধটি ট্রাম্পের সম্ভাব্য দ্বিতীয় মেয়াদের প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ওপর তার প্রভাব নিয়ে আলোচনা করবে।
মধ্যপ্রাচ্যে জটিল সমীকরণ ও ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত
মধ্যপ্রাচ্যে ট্রাম্পের নীতি সবচেয়ে বেশি বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের প্রেক্ষাপটে ট্রাম্প প্রশাসন ইসরায়েলের প্রতি একপেশে সমর্থন দিয়েছে, যা ঐতিহ্যগত মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির একটি বড় বিচ্যুতি। সম্প্রতি, ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধ এবং এই অঞ্চলে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে। ইরান এবং তার মিত্রদের পক্ষ থেকে বারবার মার্কিন ঘাঁটিতে আক্রমণ হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদ আসলে মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা আরও ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। তার চরমপন্থী নীতি ইসরায়েলকে আরও আগ্রাসী হতে উৎসাহিত করতে পারে, যা সমগ্র অঞ্চলকে একটি বড় ধরনের যুদ্ধে ঠেলে দিতে পারে।
ইউরোপীয় দেশগুলো, যেমন ফ্রান্স, জার্মানি এবং ইংল্যান্ডের ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি ট্রাম্পের নীতির সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। ঐতিহ্যগতভাবে, আমেরিকা ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতির বিরোধিতা করে আসছে। যদি ইউরোপের প্রধান দেশগুলো ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়, তবে এটি আমেরিকার সাথে তাদের সম্পর্কের মধ্যে বড় ধরনের ফাটল ধরাতে পারে। ট্রাম্পের মতো একজন নেতা, যিনি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আপস-রফার চেয়ে চাপ প্রয়োগে বেশি বিশ্বাসী, তিনি এই বিরোধের মুখে ইউরোপীয় দেশগুলোর ওপর বাণিজ্যিক এবং অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগ করতে পারেন। ট্রাম্প অতীতেও তার মিত্রদের ওপর উচ্চ শুল্ক আরোপ করার হুমকি দিয়েছেন, যা ভবিষ্যতে ৩০০ শতাংশ পর্যন্তও হতে পারে। ট্রাম্পের এমন অনির্দেশ্য মনোভাব আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে আরও জটিল করে তুলবে।
ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাত এবং ন্যাটো জোটের ভবিষ্যত
ইউক্রেন-রাশিয়া সংঘাতের ব্যাপারে ট্রাম্পের অবস্থান ইউরোপের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ বাড়িয়েছে। ইউক্রেনকে সামরিক এবং আর্থিক সহায়তা প্রদানের বিষয়ে ট্রাম্পের অনিচ্ছা এবং রাশিয়াকে মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে আমেরিকার চিরাচরিত নেতৃত্বের ভূমিকা থেকে সরে আসার সম্ভাবনা ইউরোপীয় দেশগুলোকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (EU) রাশিয়াকে মোকাবিলা করার জন্য দীর্ঘকাল ধরে আমেরিকার নেতৃত্বের উপর নির্ভরশীল। ট্রাম্প যদি সেই ভূমিকা থেকে সরে আসেন, তবে ইউরোপকে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য নতুন কৌশল খুঁজে বের করতে হবে। এই পরিস্থিতিতে ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে বিভাজন তৈরি হতে পারে। কিছু দেশ নিজেদের সামরিক সক্ষমতা বাড়াতে চাইবে, আবার কিছু দেশ রাশিয়ার সাথে একটি আপস-রফায় যেতে চাইতে পারে। এটি ন্যাটো জোটের ভবিষ্যতকেও ঝুঁকিতে ফেলতে পারে, কারণ ট্রাম্প দীর্ঘদিন ধরে এই জোটের কার্যকারিতা এবং এর ব্যয়ভার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তার মতে, ন্যাটো জোটের অনেক সদস্য দেশ তাদের প্রতিরক্ষা খাতে পর্যাপ্ত ব্যয় করছে না এবং তারা আমেরিকার কাঁধে ভর দিয়ে চলছে।
বিশ্ববাণিজ্য ও শুল্ক নীতি
ট্রাম্পের শুল্ক নীতি বিশ্বজুড়ে বাণিজ্য সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি বড় বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। চীন এবং ভারতের মতো উদীয়মান অর্থনীতির সাথে আমেরিকার শুল্ক বিরোধ ওয়াশিংটনের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য অংশীদারিত্বকে হুমকির মুখে ফেলেছে। ট্রাম্পের এই নীতি শুধু বাণিজ্যকেই নয়, বরং রাজনৈতিক সম্পর্ককেও প্রভাবিত করছে। যদি ট্রাম্প ভারতের সাথে চলমান সম্পর্কের টানাপোড়েন না কাটিয়ে ওঠেন, তাহলে দুই মিত্র দেশের মধ্যে আরও সম্পর্কের অবনতি ঘটতে পারে। এতে দক্ষিণ এশিয়ায় আমেরিকার অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়বে। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে চীন এই অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব আরও বাড়াতে পারে, যা আমেরিকার কৌশলগত স্বার্থের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে ক্ষতিকর হবে। ভারতের মতো একটি কৌশলগত মিত্রকে হারানো আমেরিকার জন্য একটি বড় ভূ-রাজনৈতিক ভুল হতে পারে।
জাতিসংঘ ও ব্রিকস জোটের উত্থান
ট্রাম্পের বিভিন্ন নীতি জাতিসংঘের মতো বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্মে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। জাতিসংঘের আসন্ন ৮০তম সাধারণ পরিষদের আলোচনায় ফ্রান্স এবং ইংল্যান্ডের মতো দেশগুলো যদি ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়, তবে এটি বৈশ্বিক মঞ্চে আমেরিকার নেতৃত্বের ওপর একটি বড় আঘাত হবে। ট্রাম্পের নীতিগুলো আন্তর্জাতিক নিয়মনীতি এবং বহুপাক্ষিক সম্পর্কের পরিবর্তে দ্বিপাক্ষিক এবং স্বার্থ-কেন্দ্রিক সম্পর্ককে প্রাধান্য দেয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি জাতিসংঘের মতো বহুপাক্ষিক সংস্থার জন্য ক্ষতিকর।
অন্যদিকে, ব্রিকস (BRICS) জোটের ক্রমবর্ধমান প্রভাব আমেরিকার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের সাথে আমেরিকার বৈরিতা ব্রিকসের মতো বিকল্প জোটের প্রতি তাদের আকর্ষণ বাড়াতে পারে। ব্রিকস একটি এমন বৈশ্বিক মঞ্চ তৈরি করছে যেখানে ডলার-নির্ভর বিশ্বব্যবস্থা এবং মার্কিন আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করা যায়। এর ফলে, বৈশ্বিক অর্থনীতি এবং ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আমেরিকার একক আধিপত্য হ্রাস পাবে।
অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ
আন্তর্জাতিক মঞ্চে ট্রাম্পের প্রভাব দুর্বল হওয়ার পেছনে তার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জও একটি বড় কারণ। খোদ আমেরিকার কয়েকটি রাজ্যে ট্রাম্প-বিরোধী মনোভাব তীব্র আকার ধারণ করেছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে ন্যাশনাল গার্ড মোতায়েনের খবরও এসেছে। একজন রাষ্ট্রপ্রধান যখন দেশের ভেতরেই এমন তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন হন, তখন আন্তর্জাতিক মঞ্চে তার নেতৃত্ব স্বাভাবিকভাবেই দুর্বল হয়ে পড়ে। অন্যান্য দেশের নেতারা ট্রাম্পের নেতৃত্বের ওপর আস্থা হারানোর এটি একটি প্রধান কারণ হতে পারে। অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা তার আন্তর্জাতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতাকে প্রভাবিত করতে পারে, কারণ তাকে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলোকে বেশি গুরুত্ব দিতে হতে পারে।
উপসংহার
ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে আমেরিকা আন্তর্জাতিক মঞ্চে এক কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি হতে পারে। ইউরোপের সাথে ফিলিস্তিন ও ইউক্রেন ইস্যুতে মতবিরোধ, ভারত ও চীনের সাথে বাণিজ্য যুদ্ধ, আন্তর্জাতিক জোটগুলোতে আমেরিকার প্রভাব হ্রাস এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিভাজন – এসবই ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের প্রভাব বিস্তার ও আমেরিকার মোড়লিপনার জন্য সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ হতে পারে। যদি আমেরিকার সাথে অন্যান্য দেশগুলোর এসব বৈরিতা স্থায়ী রূপ পায়, তবে জাতিসংঘের আসন্ন সাধারণ পরিষদে আমেরিকার নেতৃত্বের ওপর কঠোর সমালোচনা ও চাপ সৃষ্টি হতে পারে। এতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক আরও অনির্দেশ্য ও বিভক্ত হয়ে পড়ার সম্ভাবনা বাড়বে। ট্রাম্পের অনির্দেশ্য নীতিগুলি শুধু আমেরিকার প্রভাবকেই নয়, বরং বিশ্বজুড়ে স্থিতিশীলতা এবং শান্তিকেও হুমকির মুখে ফেলতে পারে।