জিবুতি (Djibouti) হল হর্ন অফ আফ্রিকা (Horn of Africa) অঞ্চলের একটি ক্ষুদ্র দেশ, যা সামরিক ও কৌশলগত দিক থেকে বিশ্বশক্তির কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভৌগোলিকভাবে এর অবস্থানই মূলত এই আগ্রহের প্রধান কারণ। লোহিত সাগর (Red Sea) এবং এডেন উপসাগরের (Gulf of Aden) সংযোগস্থলে অবস্থিত হওয়ায় জিবুতিতে সামরিক উপস্থিতি বিভিন্ন দেশের জন্য তাদের বৈশ্বিক বাণিজ্যিক ও সামরিক প্রভাব বিস্তারে সহায়ক।জিবুতি সিটি
ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব
জিবুতি কেন এতো গুরুত্বপূর্ণ, তা বুঝতে হলে এর ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানকে সবার আগে বিবেচনা করতে হবে। এটি বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত বাণিজ্যিক সমুদ্রপথের পাশে অবস্থিত, যা সুয়েজ খাল (Suez Canal) হয়ে এশিয়া, ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে। এই সমুদ্রপথ দিয়ে প্রতি বছর হাজার হাজার বাণিজ্যিক জাহাজ চলাচল করে। তাই এই পথে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা বা বাণিজ্যিক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করার জন্য জিবুতিতে সামরিক ঘাঁটি থাকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
জিবুতিতে বিভিন্ন দেশের সামরিক উপস্থিতি
জিবুতিতে একাধিক দেশের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। এদের মধ্যে কিছু দেশের স্থায়ী ঘাঁটি আছে, আবার কিছু দেশের উপস্থিতি অস্থায়ী বা সীমিত।
স্থায়ী সামরিক ঘাঁটি
ফ্রান্স: ফ্রান্সের সামরিক উপস্থিতি জিবুতিতে সবচেয়ে পুরনো। ১৯ শতক থেকে ফরাসিরা এখানে অবস্থান করছে। জিবুতি একসময় ফ্রান্সের উপনিবেশ ছিল। বর্তমানে ফরাসি সেনাবাহিনীর একটি বড় ঘাঁটি এখানে রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র: যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটি, ক্যাম্প লেমোনিয়ার (Camp Lemonnier), জিবুতিতে অবস্থিত। এটি সন্ত্রাসবাদ দমনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র এবং ইয়েমেন, সোমালিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের সামরিক অভিযানে সহায়তা করে।
চীন: ২০১৪ সালে চীন জিবুতিতে তাদের প্রথম এবং একমাত্র বিদেশী সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে। এর মাধ্যমে চীন ভারত মহাসাগরে তাদের সামরিক প্রভাব বাড়াতে সক্ষম হয় এবং বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (Belt and Road Initiative) জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র তৈরি করে।
জাপান: জাপানের আত্মরক্ষা বাহিনীও এখানে একটি স্থায়ী ঘাঁটি স্থাপন করেছে, যার প্রধান উদ্দেশ্য হল জলদস্যু দমন। এটি জাপানের প্রথম এবং একমাত্র বিদেশী সামরিক ঘাঁটি।
অস্থায়ী বা সীমিত উপস্থিতি
ইতালি, স্পেন, জার্মানি, সৌদি আরব এবং কিছু ইউরোপীয় দেশ: জলদস্যুতা বিরোধী অভিযান এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক মিশনে অংশগ্রহণের জন্য এই দেশগুলোর সামরিক বাহিনী মাঝেমধ্যে জিবুতিতে আসে। এদের কোনো স্থায়ী ঘাঁটি নেই, তবে তারা প্রায়ই ক্যাম্প লেমোনিয়ারের মতো ঘাঁটিতে অবস্থান করে।
বিশ্ববাণিজ্যে জিবুতির গুরুত্ব
জিবুতির ভৌগোলিক অবস্থান বিশ্ববাণিজ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লোহিত সাগর এবং এডেন উপসাগরের সংযোগস্থলে অবস্থিত হওয়ায় এটি বাব-এল-মান্দেব প্রণালীর (Bab-el-Mandeb Strait) কাছে অবস্থিত। এই প্রণালী বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জলপথ। মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপে তেল ও গ্যাস সরবরাহ এবং এশিয়া থেকে ইউরোপে বিভিন্ন পণ্য পরিবহনের জন্য এই পথ অপরিহার্য। এই এলাকায় জলদস্যুতা এবং অন্যান্য নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকায় জিবুতিতে সামরিক ঘাঁটি থাকা বাণিজ্যিক জাহাজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সাহায্য করে।
ভারত ও রাশিয়ার আগ্রহ
বর্তমানে ভারত এবং রাশিয়া জিবুতিতে নিজেদের সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করতে আগ্রহী। এর পেছনে একাধিক কারণ আছে:
ভারতের আগ্রহ: ভারত মহাসাগর অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের কারণে ভারত চিন্তিত। চীনের 'স্ট্রিং অফ পার্লস' (String of Pearls) কৌশলকে মোকাবিলার জন্য ভারত জিবুতিতে একটি সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করতে চায়। এই কৌশল অনুযায়ী, চীন ভারত মহাসাগরের উপকূলবর্তী বিভিন্ন দেশে বাণিজ্যিক ও সামরিক বন্দর তৈরি করছে। জিবুতিতে ঘাঁটি থাকলে ভারত এই অঞ্চলে নিজের নৌবাহিনীকে আরও কার্যকরভাবে মোতায়েন করতে পারবে এবং বাণিজ্যিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারবে।
রাশিয়ার আগ্রহ: রাশিয়াও ভূ-রাজনৈতিকভাবে এই অঞ্চলে নিজেদের প্রভাব বাড়াতে চায়। কৃষ্ণ সাগরে তাদের প্রবেশ সীমিত হওয়ায় লোহিত সাগর ও ভারত মহাসাগরে প্রবেশাধিকার পাওয়া রাশিয়ার জন্য জরুরি। জিবুতিতে সামরিক ঘাঁটি থাকলে রাশিয়া মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা এবং এশিয়ার সামরিক ও বাণিজ্যিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারবে।
জিবুতির জনসংখ্যা, অর্থনীতি ও স্বাধীনতার ইতিহাস
জনসংখ্যা
জিবুতির জনসংখ্যা খুবই কম। ২০২১ সালের হিসাব অনুযায়ী, এর জনসংখ্যা প্রায় ১ মিলিয়ন (১০ লাখ)। এর বেশিরভাগ মানুষই শহরাঞ্চলে বসবাস করে। জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই রাজধানী জিবুতি শহরে থাকে। জিবুতির জাতিগত গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সোমালি এবং আফার জাতিগোষ্ঠী প্রধান।
অর্থনীতি
জিবুতির অর্থনীতি মূলত তার কৌশলগত অবস্থানের উপর নির্ভরশীল। দেশের প্রধান আয়ের উৎস হল বিদেশী সামরিক ঘাঁটিগুলোর ভাড়া এবং লোহিত সাগর ও এডেন উপসাগরের মধ্যে চলাচলকারী জাহাজ থেকে নেওয়া বন্দর মাশুল। জিবুতিতে খুব বেশি প্রাকৃতিক সম্পদ নেই, এবং শিল্পও তেমন উন্নত নয়। দেশটির অর্থনীতি মূলত সেবা-ভিত্তিক, যেখানে বন্দর সেবা এবং বাণিজ্যই প্রধান। বিদেশী সামরিক ঘাঁটিগুলো থেকে প্রাপ্ত অর্থ এবং বৈদেশিক সহায়তা জিবুতির অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
স্বাধীনতার ইতিহাস
জিবুতি একসময় ফরাসি উপনিবেশ ছিল এবং তখন এর নাম ছিল ফরাসি সোমালিল্যান্ড (French Somaliland)। এটি ১৯৭৭ সালের ২৭ জুন ফ্রান্সের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতা লাভের পর এর নাম পরিবর্তন করে জিবুতি রাখা হয়। দেশটি ফরাসি ভাষা এবং সংস্কৃতির ব্যাপক প্রভাব ধারণ করে। যদিও এটি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র, তবে এর অর্থনীতি ও প্রতিরক্ষার ক্ষেত্রে ফ্রান্সের ওপর এর নির্ভরতা এখনও অনেক।