Boxed Style

আইফোন জিতে ক্লিক করুন

Saturday 10 October 2015

কিশোরীর জরায়ুতে ছিল দুটি সাপের বাচ্চা

নিজস্ব প্রতিবেদক | আপডেট:
কন্যাশিশু দিবস ২০১৫ উপলক্ষে ‘কিশোরী শক্তি ও সক্ষমতা: রূপকল্প ২০৩০’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচক ও অতিথিরা। আজ শনিবার সকালে কারওয়ানবাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে ইউএনএফপিএ-প্রথম আলোর উদ্যোগে এ বৈঠক হয়। ছবি: জাহিদুল করিমনবম শ্রেণিতে পড়ুয়া কিশোরী স্কুলে যাওয়ার পর একটু পরপর উসখুস করছিল। এক সময় সে অজ্ঞান হয়ে গেল। তারপর মারা গেল। পোস্টমর্টেম করার পর কিশোরীর জরায়ুতে দুটি সাপের বাচ্চা পাওয়া যায়। ঘটনাটি ঘটে ২০০৯ সালে। যশোরের ঝিকরগাছার ওই কিশোরীর মাসিক হয়েছিল। সে মাসিকের পুরোনো কাপড় শুকাতে দিয়েছিল কোনো স্যাঁতসেঁতে জায়গায়। সেখান থেকেই হয়তো সাপের বাচ্চা দুটো কাপড়ে লাগে। কিন্তু স্কুলে গিয়ে অস্বস্তি হলেও কাউকে বলতে পারেনি সে কথা।
আজ শনিবার প্রথম আলো ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল আয়োজিত ‘কিশোরী শক্তি ও সক্ষমতা: রূপকল্প ২০৩০’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে কিশোরীর এ ঘটনাটি বলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্কুল হেলথ প্রোগ্রামের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার চিকিৎসক শফিউর রহমান। বেসলাইন সার্ভে করার সময় তিনি এ তথ্য জানতে পারেন। তিনি জানান, ২০১১ সালের আগ পর্যন্ত সরকারের কার্যক্রমে কিশোরীদের স্বাস্থ্যের বিষয়টি সেভাবে গুরুত্ব পায়নি। বর্তমানে স্কুল হেলথ প্রোগ্রামের সঙ্গে অ্যাডোলেসেন্ট বা কিশোর-কিশোরীদের বিষয়টি যোগ হওয়ায় তাদের বিভিন্ন বিষয়ে সচেতন করা সম্ভব হচ্ছে।
জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সম্পাদক নাছিমা আক্তার জলি তিন থেকে চার মাস আগে মেহেরপুরের ঘটনা উল্লেখ করে জানালেন, এক মেয়ের মাসিকের কাপড়ের মধ্যে জোঁক পাওয়া যায়। প্রচুর রক্তক্ষরণ হলেও মেয়েটি বেঁচে যায়।
কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ে কন্যাশিশু দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকের অন্য আলোচকেরাও দেশে কিশোরীদের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের কথা তুলে ধরেন। কিশোরীদের দিকে নজর বাড়িয়ে তাদের যোগ্য করে গড়ে তুলে ২০৩০ সাল নাগাদ অন্য এক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নের কথাও বলেন তাঁরা। বৈঠকে সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম।
বৈঠকে দেশের কিশোরীদের সার্বিক অবস্থা তুলে ধরেন জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের ন্যাশনাল প্রোগ্রাম অফিসার (ইয়ুথ অ্যান্ড অ্যাডোলেসেন্ট) মোহাম্মদ মুনির হাসান। তিনি বলেন, কিশোরীদের একটি বড় অংশই যদি বাল্যবিবাহ ও অপ্রাপ্ত বয়সে মাতৃত্বের কারণে হারিয়ে যায়, তাহলে দেশের উন্নয়ন যাত্রা ব্যাহত হবে এবং রূপকল্প ২০৩০ অর্জনের বিষয়টিও কঠিন হয়ে পড়বে।
গোলটেবিল বৈঠকের প্রধান অতিথি মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, ‘দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। তবে এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। কিশোরীদের ক্ষেত্রে বাল্যবিবাহ একটি বড় চ্যালেঞ্জ। প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে শিক্ষকেরাও ক্লাসে পড়াতে চান না। আমরাও অনেক সময় কথাগুলো বলতে বিব্রতবোধ করি। কিশোর-কিশোরীদের প্রজনন স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন বিষয়ে সচেতন করতে “পিয়ার গ্রুপ” বা সমবয়সীদের মাধ্যমেই যাতে সচেতনতা তৈরি করা যায়, এ বিষয়টিতে গুরুত্ব দিতে হবে।’
মেহের আফরোজ বলেন, পরিবারের ভেতরেই ছেলে ও মেয়েশিশুর প্রতি বৈষম্য করা হয়। সন্তানের শিক্ষা, পুষ্টিসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগের সময় ছেলে সন্তান প্রাধান্য পায়। মেয়ের পুষ্টি দরকার, ভবিষ্যতে সে সন্তান জন্ম দেবে, তা নিয়ে চিন্তা করা হয় না।
বক্তব্যে গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী প্রতি পদে পদে বাধা থাকায় বাংলাদেশে কিশোরীদের কৈশোর বলে কিছু আছে কি না, তা নিয়েই প্রশ্ন তোলেন। তিনি বলেন, ‘কন্যা’ শিশু কথাটির মধ্যেই এক ধরনের স্টিগমা আছে। বিয়ের কনে মনে হয়। তাই কন্যাশিশু না বলে মেয়েশিশু বলতে হবে। শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া, প্রযু​ক্তির অপব্যবহারের শিকার থেকে রক্ষা করা এবং পথশিশুদের দিকে নজর বাড়ানোর কথা বলেন রাশেদা কে চৌধূরী। এ ছাড়া বিভিন্ন এনজিও শিশু-কিশোরীদের নিয়ে যে কাজগুলো করছে, তার মধ্যে থেকে ইতিবাচক কাজগুলোকে সরকার যাতে মূলধারার কাজে সম্পৃক্ত করে, সে সুপারিশও করেন তিনি।
আলোচনায় অপরাজেয় বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ওয়াহিদা বানু বলেন, দেশের ১০ লাখ পথশিশুর কোনো অভিভাবক নেই। এই শিশুদের জন্য শিশুবান্ধব পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। এ ছাড়া শিশুসংশ্লিষ্ট আইন ও নীতির বাস্তবায়ন, কিশোর-কিশোরীদের ব্যক্তি পর্যায়ের প্রতিভাকে গুরুত্ব দেওয়া, স্থানীয় সরকার এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের কর্মসূচি সমন্বয়ক আবদুল্লা আল মামুন বলেন, একজন আরেকজনের সঙ্গে দেখা হলেই জানতে চান, আপনার ছেলে কী করে, আপনার মেয়ের বিয়ে হয়েছে? অর্থাৎ মেয়েদের বিয়েই হলো গন্তব্য। বিয়ে শুধু গন্তব্য না হয়ে মেয়ে কী করে, এ ধরনের প্রশ্ন করার মনমানসিকতা তৈরি করতে হবে। প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধ, গৃহকর্মীদের সুরক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি ছেলেশিশুদের সামাজিকীকরণে মনোযোগ বাড়াতে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক চিকিৎসক শিমুল কলি হোসেন বলেন, কিশোর-কিশোরীরা লাজুক থাকে। বিশেষ করে যখন তাদের কোনো সেবাকেন্দ্রে যেতে হয়, তখন লজ্জা বেড়ে যায়। সেবাপ্রদানকারীরাও অনেক সময় তাদের গুরুত্ব দেন না বা ভালো ব্যবহার করেন না। এসব দিক বিবেচনায় সরকার ১৩টি জেলায় কৈশোরবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র গড়ে তুলেছে। এসব কেন্দ্রে মাসিক থেকে শুরু করে এইচআইভি এইডসসহ বিভিন্ন বিষয়ে কাউন্সেলিং ও সেবা দেওয়া হচ্ছে। এ ধরনের কেন্দ্রের সংখ্যা আরও বাড়ানো হবে।
বাংলাদেশ শিশু একাডেমীর গ্রন্থাগার বিভাগের বিভাগীয় প্রধান রেজিনা আখতার বলেন, শিশুদের জন্য কিছু করা মানেই বিনিয়োগ করা। পাঁচ বা ১০ বছর পর সে বিনিয়োগের ফলাফল পাওয়া যায়। তিনি জানালেন, মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কিশোর-কিশোরী ক্লাবের মাধ্যমে ছেলে ও মেয়ের মধ্যে বিভেদ দূর করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে।
জাতিসংঘ শিশু তহবিল—ইউনিসেফের শিশু সুরক্ষা বিশেষজ্ঞ শাবনাজ জাহেরীন বলেন, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় শিশু-কিশোরদের নিয়ে বিভিন্ন কর্মসূচি পরিচালনা করছে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে সেগুলো সমন্বয় করতে হবে। নজরদারি করতে হবে। সরকারের বিভিন্ন আইন ও নীতি বাস্তবায়নে সুনির্দিষ্ট বাজেট বরাদ্দ করতে হবে। আরবানাইজেশন বা নগরায়ণের বিষয়টি নিয়েও এখন থেকেই চিন্তাভাবনা করার সুপারিশ করেন তিনি।
জাতীয় কন্যাশিশু অ্যাডভোকেসি ফোরামের সম্পাদক নাছিমা আক্তার জলি জানালেন, ফোরামের পক্ষ থেকে নওগাঁ, মেহেরপুর ও রংপুরে ৩২০টি স্কুলে মেয়েদের জন্য নিরাপদ স্কুল শীর্ষক একটি কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে। এ কর্মসূচিতে স্কুলের একজন নারী শিক্ষকের কাছে শিক্ষার্থীরা সমস্যার কথা বলতে পারছে। মেয়েদের জন্য আলাদা টয়লেট এবং মাসিকের ন্যাপকিন ফেলার জায়গা করা হয়েছে। স্কুলে আসার পর কারও মাসিক শুরু হলে তার জন্য স্কয়ারের সহায়তায় ন্যাপকিনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। স্কুল থেকে মেয়েরা যাতে ঝরে না যায়, সে জন্য সে ধরনের পরিবেশ নিশ্চিত করার পাশাপাশি অভিভাবক ও এলাকার ছেলে-মেয়েদের নিয়ে কমিটি তৈরি করা হয়েছে। এ কর্মসূচির ফলে গত বছরের তুলনায় চলতি বছরে মেয়েদের ঝরে পড়ার হার ২০ শতাংশ কমেছে।
অভিনয়শিল্পী দীপা খন্দকার বলেন, পুত্রশিশুদের শেখাতে হবে তারা কীভাবে মেয়ে বা কন্যাশিশুর সঙ্গে আচরণ করবে। মেয়েদের মাসিক শুরু হলে বাবা বা ভাই কেন তা জানতে পারবে না? মাসিকের কাপড় কেন খোলামেলা জায়গায় শুকানো যাবে না? ছেলেরা তাদের বয়ঃসন্ধিকালে শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের কথা কেন বলতে পারবে না? এসব ক্ষেত্রে মনমানসিকতার পরিবর্তন জরুরি।
জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের নির্বাহী পরিচালক বাবাটুন্ডে অসোটিমেহিন ১১ অক্টোবর আন্তর্জাতিক কন্যাশিশু দিবস উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন। আজকের গোলটেবিল বৈঠকে ওই বাণী পড়ে শোনান সংস্থাটির যোগাযোগ কর্মকর্তা আসমা আক্তার।