বাংলাদেশের রেলমন্ত্রী সিলবেনাফিল সাইট্রেট অথবা ভায়াগ্রার ওপর নির্ভর
করবেন যথেষ্ট, অনুমান করি। ভায়াগ্রা সেবনেরও একটা সীমা আছে। সব শরীরে
ভায়াগ্রা সয় না। বিশেষ করে রক্তচাপ, হৃদপিণ্ড, কিডনি, লিভার ইত্যাদিতে কোনও
সমস্যা থাকলে ভায়াগ্রা নিষিদ্ধ। রেলমন্ত্রী একটি জলজ্যান্ত যুবতী শরীর
নিয়ে খেলবেন। খেলায় পারদর্শী না হলেও খেলবেন। কারণ তিনি পুরুষ। তাঁর যাকে
ইচ্ছে তাকে নিয়ে খেলা করার অধিকার আছে। গোটা পৃথিবীটাই পুরুষের খেলার মাঠ।
মেয়েটি যৌনতৃষ্ণায় কাতরাবে। চরম হতাশায় ভুগবে। কিন্তু পুরুষের সংসার-
খাঁচায় বন্দি হয়ে থাকতে সে বাধ্য হবে। কারণ সে একটা খেলনা।
সেদিন টুইটারে লিখেছিলাম আমার বয়ফ্রেন্ড আমার চেয়ে কুড়ি বছরের ছোট।
খবরটা লুফে নিলো মিডিয়া। অথচ কত খবরই তো দিই টুইটারে, আমার পুরস্কার পাওয়ার
খবর, অনারারি ডকটোরেট পাওয়ার খবর, আমার কীনোট স্পীচ দেওয়ার খবর, আমার
স্ট্যাণ্ডিং ওভেশন পাওয়ার খবর। এসব খবরে মিডিয়ার উৎসাহ নেই মোটেও। আমার
প্রেমিক এবং স্বামী নিয়ে মিডিয়ার উৎসাহ বরাবরই অবশ্য প্রবল। যাই হোক, যা
বলছিলাম। আমার চেয়ে কুড়ি বছরের ছোট প্রেমিকের খবরখানা টুইটারে দিয়ে একধরণের
পুলক বোধ করছিলাম। পুরুষের মতো কোনও আচরণ করা মেয়েদের মানায় না। তাই
পুরুষের মতো আচরণ করে, বয়সে ছোট এক সঙ্গী নির্বাচন করে, দেখতে চাইছিলাম
সমাজ কী বলে। যথারীতি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো।
আর এদিকে আমাকে টেক্কা দিয়ে ৬৭ বছর বয়সী রেলমন্ত্রী ধুমধাম করে বিয়ে করে
বসলেন তাঁর চেয়ে প্রায় চল্লিশ বছরের ছোট এক মেয়েকে। কোথায় কুড়ি আর কোথায়
চল্লিশ। আমি তো নেহাতই বয়ফ্রেন্ড অবধি। আর উনি রীতিমত বিয়ে করলেন, রীতিমত
গায়ে হলুদ করে, প্রচুর গয়না গাটি আর লাল বেনারসি পরে সাজানো কনেকে, আর নিজে
মাথায় পাগড়ি টাগড়ি চাপিয়ে। কোনও ৬৭ বছর বয়সী মহিলার কি সাধ্য আছে ২৯ বছর
বয়সী কোনও ছেলেকে এভাবে ধুমধাম করে বিয়ে করার? মন্ত্রীর বিয়েতে যেভাবে
সমাজের নারীপুরুষ উৎসব করলো, এমন জমকালো উৎসব কি করবে প্রায় সত্তর বছর বয়সী
মহিলা আর কুড়ির কোঠায় বয়স এমন কোনও ছেলের বিয়েতে? অনেকে বলবে, পুরুষ ধনী
এবং প্রভাবশালি হলে গোড়ালির বয়সী মেয়েদের বিয়ে করা সম্ভব। আমার প্রশ্ন,
বাংলাদেশের কোনও ধনী এবং প্রভাবশালি মহিলার পক্ষে কি সম্ভব গোড়ালির বয়সী
ছেলেদের বিয়ে করা? সম্ভব তো নয়ই, বরং লোকে তাকে পুরুষখেকো ডাইনি বলে গালি
দিয়ে সব্বনাশ করবে, একঘরে করবে, বলা যায় না জ্যান্ত জবাই হয়ে যেতে পারে সেই
মহিলা।
জানি অনেকে বলবে, বুড়ো পুরুষের শরীরে শুক্রাণু তৈরি হয়, সুতরাং তাদের
পক্ষেও ঋতুময়ী মেয়েদের গর্ভবতী করা সম্ভব, আর ওদিকে রজঃশ্রাব বন্ধ হলে
নারীর পক্ষে সম্ভব নয় গর্ভবতী হওয়া। কিন্তু কম লোকই জানে বুড়ো পুরুষের
শুক্রাণু তৈরি হয় বটে, তবে সংখ্যাটা বেজায় কম, এবং শুক্রাণুর চেহারা-চরিত্র
মোটেই ভালো নয়। যুবকের শুক্রাণু আর বৃদ্ধের শুক্রাণুতে আকাশ পাতাল তফাৎ।
বৃদ্ধের শুক্রাণুতে গর্ভবতী হওয়া চাট্টিখানি কথা নয়, বছরের পর বছর লেগে
যায়। অথবা কাউকে গর্ভবতী করার ক্ষমতাই ধারণ করে না ওসব ভাঙা, নষ্ট, ক্ষুদ্র
শুক্রাণুগুলো। পুরুষের শরীরে টেস্টোস্টেরন হরমোন কমে যায় বুড়ো বয়সে, আর সে
কারণেও কিন্তু সন্তান জন্ম নেয় ক্রোমোজমের জটিল সমস্যা নিয়ে। সুতরাং যারা
বলে পুরুষ বুড়ো হলেও সন্তান বিশেষ করে সুস্থ সন্তান উৎপাদনে সম্ভব, তারা
খুব নির্ভুল কথা কিন্তু বলে না।
প্রেম কোনও বয়স মানে না, প্রাপ্ত বয়স্ক যে কোনও বয়সের মানুষের মধ্যে
প্রেম ঘটতে পারে, আমরা জানি। তাহলে পুরুষ আর নারীর মধ্যে শুধু পুরুষকেই
বয়সে বড় হতে হবে কেন! আর ভালবাসা প্রধান হলে, সন্তান জন্মটা প্রধান নাও হতে
পারে। অনেক নারী-পুরুষ সন্তান নেবে না, এই শর্তেই একত্রবাস করে অথবা বিয়ে
করে। আজকাল এই শর্তটি দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে ৬৭ বছর বয়সী
মহিলা আর ২৯ বছর বয়সী ছেলের মধ্যে প্রেম বা প্রেমের কোনও বিয়ে নিয়ে কারও
আপত্তি করার প্রশ্ন তো ওঠে না। কিন্তু মানুষ আপত্তি করে। যে কাণ্ড করে ৬৭
বছর বয়সী পুরুষ সমাজে আদৃত হয়, সেই একই কাণ্ড করে ৬৭ বছর বয়সী মহিলা সমাজে
ঘৃণিত হয়। নারী-পুরুষের মধ্যে যে ভয়াবহ বৈষম্য, সেটির সামান্য একটি উদাহরণ
এটি।
চৌদ্দশ বছর আগে চল্লিশ বছর বয়সী বিধবা খাদিজা(রা.) ২৫ বছর বয়সী মুহাম্মদ
(সা.) পছন্দ করে বিয়ে করেছিলেন। আজকের আরবে আধুনিক খাদিজাদের সেই সাধ্য বা
সাহস নেই। খাদিজার (রা.) মৃত্যুর পর মুহাম্মদ (সা.) বেশ কয়েকটি বিয়ে
করেছিলেন, তাঁর চেয়ে প্রায় পঞ্চাশ বছরের ছোট এক মেয়েকেও বিয়ে করেছিলেন।
মহানবীর (সা.) অনুসারীরা মহানবীর(সা.) এই বয়সে ছোট কাউকে বিয়ে করার
ব্যাপারটি অনুসরণ করে চলেছেন। মহানবী(সা.) যে তাঁর চেয়ে পনেরো বছরের বড় এক
বিধবাকে বিয়ে করেছিলেন, সেটি অনুসরণ করতে কোনও খাঁটি মুসলমানও আগ্রহী নয়।
বাংলাদেশের রেলমন্ত্রী সিলবেনাফিল সাইট্রেট অথবা ভায়াগ্রার ওপর নির্ভর
করবেন যথেষ্ট, অনুমান করি। ভায়াগ্রা সেবনেরও একটা সীমা আছে। সব শরীরে
ভায়াগ্রা সয় না। বিশেষ করে রক্তচাপ, হৃদপিণ্ড, কিডনি, লিভার ইত্যাদিতে কোনও
সমস্যা থাকলে ভায়াগ্রা নিষিদ্ধ। রেলমন্ত্রী একটি জলজ্যান্ত যুবতী শরীর
নিয়ে খেলবেন। খেলায় পারদর্শী না হলেও খেলবেন। কারণ তিনি পুরুষ। তাঁর যাকে
ইচ্ছে তাকে নিয়ে খেলা করার অধিকার আছে। গোটা পৃথিবীটাই পুরুষের খেলার মাঠ।
মেয়েটি যৌনতৃষ্ণায় কাতরাবে। চরম হতাশায় ভুগবে। কিন্তু পুরুষের সংসার-
খাঁচায় বন্দি হয়ে থাকতে সে বাধ্য হবে। কারণ সে একটা খেলনা। একটা যৌনখেলনা।
একটা ডেকোরেশন পিস। সুখী না হয়েও সুখী সুখী ভাব করতে হয়তো সে বাধ্য হবে।
সমাজের বেশির ভাগ মেয়েরা যা করে। সুখী নয়, অথচ সুখী হওয়ার ভাব করে। অথবা
দুঃখকেই, না পাওয়াকেই, পরাধীনতাকেই সুখ বলে, পাওয়া বলে, স্বাধীনতা বলে
ভাবে। ভাবতে শিখেছে ছোটবেলা থেকেই। নতুন করে এর বিপরীত কিছু শেখা সম্ভবত
অধিকাংশ মেয়ের পক্ষেই আর সম্ভব নয়। পুরুষ যা শিখেছে ছোটবেলা থেকে তা হল,
তারা প্রভু, তারা সুপিরিওর, তারা জানে বেশি, বোঝে বেশি, তাদের জন্য সমাজ,
তাদের জন্য জগত, তারা শাসন করবে, তারা ভোগ করবে। এই শিক্ষাটা না শিখতে এবং
এর বিপরীত কিছু শিখতে অধিকাংশ পুরুষই রাজি নয়।
তসলিমা নাসরিন: লেখক ও কলামিস্ট।