Boxed Style

আইফোন জিতে ক্লিক করুন

Saturday 17 May 2014

খড়কুটোর মতো ভেসে গেল কংগ্রেস

দায় স্বীকার করলেন সোনিয়া-রাহুল
ভারতের স্বাধীনতায় নেতৃত্ব দিয়েছিল দলটি। স্বাধীনতার পর বেশিরভাগ সময় ক্ষমতায়ও ছিল। স্বাধীন ভারতে দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন নেহরু-গান্ধী পরিবারের কেউ না কেউ।
নয়াদিলি্ল প্রতিনিধি
খড়কুটোর মতো ভেসে গেল কংগ্রেসভারতের স্বাধীনতায় নেতৃত্ব দিয়েছিল দলটি। স্বাধীনতার পর বেশিরভাগ সময় ক্ষমতায়ও ছিল। স্বাধীন ভারতে দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন নেহরু-গান্ধী পরিবারের কেউ না কেউ। ঐতিহ্যবাহী এই পরিবার থেকে তিন-তিনজন প্রধানমন্ত্রী পেয়েছে ভারত। এবার হঠাৎ ভারতীয়রা সেই দলটির প্রতি এত বিমুখ হলো যে, খড়কুটোর মতো ভেসে গেল কংগ্রেস, কিন্তু কেন? লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের লজ্জাজনক পরাজয়ে এ প্রশ্নই ঘুরেফিরে আসছে। তবে পরাজয়ের পেছনে যে বিষয়গুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে তার মধ্যে দুর্নীতি, পরিবারতন্ত্র, সুশাসনের অভাব, তরুণ ভোটার, গণমাধ্যমে বিরূপ প্রচার ও কেজরিওয়াল ফ্যাক্টর অন্যতম। এ ছাড়া প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে সঠিক সময়ে কাজে লাগাতে না পারা, রাহুলের অনুজ্জ্বল প্রচারও অন্যতম।
এদিকে লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের ভরাডুবির দায় স্বীকার করে নিলেন দলের সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধী এবং সহসভাপতি রাহুল গান্ধী। গতকাল শুক্রবার ১৬তম লোকসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর কংগ্রেসের বিশাল বিপর্যয়ের মুখে তারা এই দায় নিজেদের কাঁধে তুলে নেন। কংগ্রেস কেন এত শোচনীয়ভাবে পরাজিত হলো_ এ প্রশ্নই এখন দলটির ভেতরে-বাইরে ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। কারণ বহুমুখী হতে পারে। কোনোটিই অস্বীকার করার উপায় নেই। বিশেষত, পরাজিত হওয়ার পর কোনো কারণকেই এড়িয়ে যাওয়া যায় না। ২০০৪ ও ২০০৯ সালে পর পর দুটি নির্বাচনে জয়ী কংগ্রেস এবারও ক্ষমতাসীন দল হিসেবে নির্বাচনে দাঁড়ায়। কিন্তু দলটির প্রস্তুতি ছিল অনুল্লেখযোগ্য। এক বছর আগে থেকেই বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী নরেন্দ্র মোদি নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। রাহুল গান্ধীরা সেই প্রস্তুতিকে উপেক্ষার চোখেই দেখেছেন। তারা নিজেরা যথাসময়ে প্রস্তুতি নেননি, প্রতিপক্ষের প্রস্তুতিকেও হালকা করে দেখেছেন। ফলে মাঠে নেমে নিজেদের আবিষ্কার করেছেন অনেক পেছনে।
টানা ১০ বছর ক্ষমতায় থেকে এমনিতেই অনেক বদনাম কুড়িয়েছিল ক্ষমতাসীন সংযুক্ত প্রগতিশীল মোর্চার (ইউপিএ) প্রধান দল কংগ্রেস। দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার হ্রাস, একের পর এক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ_ গত পাঁচ বছরে এসব দুর্যোগ পিছু ছাড়ছিল না কংগ্রেসের। এসব কারণে মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে তা একেবারেই আমলে আনেননি কংগ্রেস নেতৃত্ব, যার মাশুল দিতে হচ্ছে এখন। এ ছাড়া ভারতের ভোটারদের মধ্যেও ক্ষমতাসীনদের ফের ক্ষমতায় বসাতে অনীহা ছিল লক্ষণীয়। তারা পরিবর্তন চেয়েছিলেন। তাদের সামনে দুর্নীতিগ্রস্ত কংগ্রেসের একমাত্র বিকল্প হিসেবে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল বিজেপি।
নির্বাচনী কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হওয়ার অনেক আগেই বিজেপি তাদের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নাম ঘোষণা করে। সংসদীয় গণতন্ত্রে এ ধরনের ঘোষণার রেওয়াজ নেই। তার পরও মোদিকে সামনে এনে বিজেপি ভোটারদের মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। ২০০২ সালের গুজরাটে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বিতর্কিত হলেও রাজ্যে প্রভূত উন্নয়ন ঘটিয়ে অনেক আগে থেকেই পরিচিত ব্যক্তিত্ব মোদি। বিপরীতে কংগ্রেস জয়ী হলে কাকে প্রধানমন্ত্রী বানাবে_ জনতার এ কৌতূহলের কোনো উত্তর ছিল না। প্রবল জনজিজ্ঞাসার মুখে জবাব দেন সোনিয়া গান্ধী। তিনি বলেন, সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করেন নির্বাচিত সাংসদরা। এটি আগে থেকে ঘোষণা দেওয়ার বিষয় নয়। জনতা এ জবাবে সন্তুষ্ট হয়নি; বরং এতে তাদের কাছে দলটির অনীহা বা সিদ্ধান্তহীনতার চিত্র প্রকট হয়।
মিডিয়াও জানায়, দলের নির্বাচনী প্রচারের মূল দায়িত্ব নিতে রাজি হলেও রাহুল গান্ধী প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হতে রাজি নন। অথচ এই রাহুলের ওপরই কংগ্রেস তাদের বাজি রেখেছিল গোটা পাঁচটি বছর। বিভিন্নভাবে তাকে দলে ক্ষমতায়ন করা হচ্ছিল। দলের ভবিষ্যৎ কর্ণধার হিসেবে দেখানো হচ্ছিল তাকে। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংসহ কংগ্রেসের শীর্ষ নেতারা প্রকাশ্যেই রাহুলের নামে জয়ধ্বনি দিচ্ছিলেন কারণে-অকারণে। যার পেছনে বাজি, তারই যদি এই মনোভাব হয় তবে ভোটারদের আর কী দোষ। তার ওপর বিজেপির প্রচার তো রয়েছেই। মোদি গোটা প্রচারকালে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন ইউপিএ সরকারকে 'মা-বেটার সরকার' বলে খুঁচিয়ে গেছেন। সরকারে না থেকেও দলীয় প্রভাবে মনমোহন সিংয়ের ওপর সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে মা ও ছেলের বিরুদ্ধে। মোদি ভোটারদের কাছে বিষয়টি চাতুর্যের সঙ্গেই তুলে ধরেছেন। কংগ্রেস তা খণ্ডাতে পারেনি।
বিজেপির মূল লক্ষ্য ছিল হিন্দিভাষী উত্তর প্রদেশ (৮০ আসন) ও বিহার (৪০ আসন)। মোদি অনেক আগেই উত্তর প্রদেশে তার ঘনিষ্ঠতম সহচর অমিত শাহকে দল গোছানোর কাজে পাঠিয়ে দেন। তিনি সেখানে প্রতিটি ভোটকেন্দ্রভিত্তিক সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে তোলেন। অন্যদিকে, কংগ্রেস নেতৃত্বের ধারণা ছিল, তারা কেন্দ্র থেকে সস্তায় খাদ্য দেওয়ার আইন করেছেন, শিক্ষার অধিকার আইন করেছেন_ এসবের ভিত্তিতেই ভোট পাবেন। এ ছাড়া মুজাফফরনগরে দাঙ্গার পর সব হিন্দু ভোট একত্র করার দিকে বিজেপি যে মনোযোগ দিয়েছিল, তা নজরেই পড়েনি কংগ্রেসের। বহু বিতর্ক সত্ত্বেও বিজেপি মোদির 'গুজরাট উন্নয়ন' মডেলকে যেভাবে তুলে ধরেছে, তাতে ভারতের ভোটারদের মধ্যে এই ধারণাই হয়েছে_ মোদি প্রধানমন্ত্রী হলে গোটা দেশে এরকম উন্নয়নই হবে। অন্যদিকে, রাহুল কোনো দিনই কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় দায়িত্ব নিতে চাননি। তিনি কী পারেন, কী পারেন না তা তো জানতেই পারলেন না ভোটাররা।
ভারতের এবারের ভোটারদের ৭০ শতাংশই তরুণ। তাদের কাছে মোদি এমন এক স্বপ্ন তুলে ধরেছেন যে, তিনি দেশের সব সমস্যার সমাধান করতে পারবেন। তরুণরা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য যা চায়, তাই হাজির করবেন তিনি। দেশের শিল্পগোষ্ঠীও ইউপিএ সরকারের অচলাবস্থায় বেজায় ক্ষুব্ধ ছিল। তারাও চাইছিল মোদির মতো একজন তেজস্বী নেতা, যিনি দ্রুতই সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। বিপরীতে রাহুল প্রভাবশালী এই শিল্পগোষ্ঠীর জন্য কোনো বার্তা দিতে পারেননি। অন্য সব খাতের মতো এ বিষয়টিও তিনি হালকাভাবে নিয়েছেন। দেশের তরুণরা, শিল্পপতিরা রাহুলের ওপর ভরসা করতে পারেননি। তাই এখন কঠিন সময় রাহুলের জন্য।হারের দায় স্বীকার করে নিলেন সোনিয়া, রাহুল নয়াদিলি্লতে এক সংবাদ সম্মেলনে লোকসভা নির্বাচনের ফল নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে সোনিয়া গান্ধী বলেন, 'আমরা জানি, জয় এবং পরাজয় গণতন্ত্রেরই অংশ।' কংগ্রেসের সহসভাপতি পুত্র রাহুলের কথার প্রতিধ্বনি করে তিনি বলেন, 'আমরা জনগণের এ সিদ্ধান্তকে সম্মান করি। আমি এই পরাজয়ের দায় স্বীকার করছি।' এবারের লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের প্রচারের নেতৃত্ব দিয়েছেন রাহুল।
গতকাল অনেক নেতাই রাহুলের নেতৃত্বে কংগ্রেসের বিপর্যয়ের পর দলের ভবিষ্যৎ নিয়ে নানা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। রাহুলের রাজনৈতিক দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
রাহুলও একই দিনে কংগ্রেসের ব্যর্থতায় নিজের দায় স্বীকার করে নেন। তিনি বলেন, 'আমি নতুন সরকারকে অভিনন্দন জানিয়ে কথা শুরু করতে চাই। এই দেশের জনসাধারণ তাদের দায়িত্ব দিয়েছে। আমরা বেশ খারাপ করেছি। সহসভাপতি হিসেবে আমি নিজেকেই দায়ী মনে করি।'ছয় সপ্তাহের দীর্ঘ লোকসভা নির্বাচনে ৯ দফা ভোটের পর গতকাল নির্বাচনী ফলে ভারতীয় জনতা পার্টিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী হতে দেখা যায়। আর ৩০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় বিপর্যয় ঘটে কংগ্রেসের। এমনকি কংগ্রেস লোকসভায় বিরোধী দল হিসেবেও অবস্থান তৈরি করতে পারবে না বলে মনে করা হচ্ছে।