Boxed Style

আইফোন জিতে ক্লিক করুন

Friday 18 April 2014

অবশেষে ঘুষ দিয়ে পদোন্নতির চেষ্টা!

ঢাকা সিটি করপোরেশনে (ডিসিসি) সহকারী প্রকৌশলী মনোয়ার হোসেন ১৯৯৫ সালের ২৩ মে চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৯৯ সালের ২২ মে চাকরির চার বছর পূর্ণ হয়।
অমিতোষ পাল
অবশেষে ঘুষ দিয়ে পদোন্নতির চেষ্টা!ঢাকা সিটি করপোরেশনে (ডিসিসি) সহকারী প্রকৌশলী মনোয়ার হোসেন ১৯৯৫ সালের ২৩ মে চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৯৯ সালের ২২ মে চাকরির চার বছর পূর্ণ হয়। জাতীয় বেতন স্কেল অনুযায়ী চার বছর মেয়াদ পূর্ণ হওয়ায় ২৩ মে ১৯৯৯ থেকে তিনি উচ্চতর পদে পদোন্নতি পাওয়ার দাবিদার। উচ্চতর পদ শূন্য না থাকলে সিলেকশন গ্রেডে উচ্চতর বেতন স্কেলে তার বেতন নির্ধারিত হওয়ার কথা। অথচ নির্ধারিত সময়ের ১৪ বছর পরও তিনি পদোন্নতি পাননি। এমনকি উচ্চতর বেতন স্কেলে তাকে সিলেকশন গ্রেডও দেওয়া হয়নি। এরই মধ্যে ডিসিসি ভেঙে দুটি সিটি করপোরেশন হয়েছে। আশা ছিল বিভাজনের পর নতুন বেতন স্কেল পাবেন। এরই মধ্যে বিভাজনেরও দু'বছরের বেশি সময় পার হয়েছে। কোনোটাই তার ভাগ্যে জোটেনি। যখনই এ ব্যাপারে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দেনদরবার করেছেন, তখনই স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় অনাগ্রহ দেখিয়েছে।
শুধু মনোয়ার হোসেনই নন, তার মতো ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনসহ দেশের পুরনো সিটি করপোরেশনগুলোর কয়েক হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীরই এ অবস্থা। অথচ এ পদোন্নতির ফলে বর্ধিত বেতনও সরকারের দিতে হবে না। করপোরেশনের ফান্ড থেকেই বেতন নির্বাহ করা হবে। তারপরও হয়নি। অবশেষে বাধ্য হয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সম্প্রতি একজোট হন। তারা মন্ত্রণালয় ও ডিএসসিসির শীর্ষ কর্মকর্তাদের খুশি করে পদোন্নতি বা সিলেকশন গ্রেড পাওয়ার উদ্যোগ নেন। এ জন্য তারা টাকা তোলা শুরু করেন। সে টাকা দিয়ে শীর্ষ কর্মকর্তাদের খুশি করবেন। বর্তমানে চলছে 'খুশি' আদায় কার্যক্রম। তাদের বিশ্বাস, এবার হয়তো অবসর নেওয়ার আগেই পদোন্নতি মিলবে।
জানা গেছে, জাতীয় বেতন স্কেল অনুযায়ী প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তারা চাকরিতে যোগদানের পর চার বছর পূর্ণ হলে পদোন্নতি পেতে পারেন। তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীর ক্ষেত্রে তা পাঁচ বছর। কিন্তু ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনেই সহস্রাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন, যারা ১০-১৫ বছর আগেই পদোন্নতি বা সিলেকশন গ্রেড পাওয়ার অধিকার অর্জন করেছেন। অথচ তারা সে ন্যায্য প্রাপ্য পাননি। বছরের পর বছর ধরে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের অনুরোধ করে আসছেন। চলতি বছরের শুরুতে আবারও এ-সংক্রান্ত একটি ফাইল মন্ত্রণালয়ে গেলে ২৪ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে চিঠি দিয়ে বরাবরের মতো নেতিবাচক অবস্থান জানিয়ে দেয়। মন্ত্রণালয় চিঠিতে বলে, ডিএসসিসির সাংগঠনিক কাঠামো (অর্গানোগ্রাম) চূড়ান্ত না হওয়ায় সিলেকশন গ্রেড প্রদানের কোনো মিটিং করা যাবে না। এর পরই কর্মচারীরা হতাশ হয়ে পড়েন। তারা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আনসার আলী খানের সঙ্গে দেখা করে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। এক পর্যায়ে তারা মন্ত্রণালয়কে খুশি করে সিলেকশন গ্রেড পাওয়ার কথা জানান। আনসার আলী সে প্রস্তাবে মৌন সম্মতিও দেন। এর পরই শুরু হয় টাকা তোলার কাজ। প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তার কাছ থেকে জনপ্রতি ৪ হাজার, দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তার কাছ থেকে ৩ হাজার ও তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীর কাছ থেকে ২ হাজার টাকা করে আদায় শুরু হয়। সবার কাছে বিশ্বস্ত ও করপোরেশনের সৎ কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত বাস টার্মিনালের ম্যানেজার মারুফ হাসানের কাছে টাকা জমা করার সিদ্ধান্ত হয়। সবাই তার কাছে গিয়ে বর্তমানে টাকা জমা রাখছেন। এরই মধ্যে প্রায় দেড় লাখ টাকা জমাও হয়েছে বলে জানা গেছে। এ প্রসঙ্গে মারুফ হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি কোনো কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান।
ডিএসসিসি সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ১৯৭ জন প্রথম শ্রেণীর, ১০০ জন দ্বিতীয় শ্রেণীর ১ হাজার ৩৩১ জন তৃতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারী রয়েছেন। তাদের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই পদোন্নতি প্রাপ্য হয়েছেন। ভুক্তভোগীরা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তারা পদোন্নতির জন্য সাদেক হোসেন খোকা মেয়র থাকাকালীনও বেশ কয়েকবার তার দ্বারস্থ হয়েছেন। মেয়র আন্তরিক থাকলেও মন্ত্রণালয় বরাবরই ভেটো দিয়ে এসেছে। সাদেক হোসেন খোকা মেয়র থেকে বিদায় নেওয়ার পর এরই মধ্যে পাঁচজন অতিরিক্ত সচিব প্রশাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রত্যেক প্রশাসকের দ্বারস্থ হয়েছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তাতেও কাজ হয়নি। বাধ্য হয়ে তারা এ অনৈতিক পথে যেতে বাধ্য হয়েছেন।এক কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে বলেন, তার চাকরিই আছে সাত-আট বছর। এবার না হলে আর তিনি পদোন্নতির মুখ দেখে যেতে পারবেন না। এতদিনে পদোন্নতি না পাওয়ায় কারও কাছে মুখ দেখাতেই তার লজ্জা হয়।
জানা গেছে, নির্ধারিত হার ছাড়াও কিছু কর্মকর্তা সামর্থ্য অনুযায়ী বেশি চাঁদা দেবেন। মোট ৩ লাখ টাকা চাঁদা তোলার লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এর মধ্যে দেড় লাখ টাকা দেওয়া হবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের এক যুগ্ম সচিবকে, ১ লাখ টাকা দেওয়া হবে এক সিনিয়র সহকারী সচিবকে, যারা সিটি করপোরেশনের পর্যবেক্ষণের দায়িত্ব পালন করেন। বাকি টাকা আরও কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে দিয়ে খুশি রাখতে হবে। বৃহস্পতিবারের মধ্যেই পুরো টাকা আদায় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হবে। পরের সপ্তাহেই তারা সংশ্লিষ্টদের কাছে উৎকোচ পেঁৗছে দেবেন।
সম্প্রতি উৎকোচের টাকা জমা দেওয়ার পর নগর ভবনে কথা হয় ঢাকা মহানগর শিশু হাসপাতালের সিনিয়র স্টাফ নার্স আছিয়া আক্তারের সঙ্গে। তিনি বলেন, ২০০৬ সালে তার পদোন্নতি পাওনা হয়েছে। যে টাকা বেতন পান, তা দিয়ে সংসার চলে না। এ জন্য তিনিও উৎকোচ দিয়ে পদোন্নতি নিতে রাজি। একই ধরনের মন্তব্য করেন মনোয়ারা আক্তার। তিনি বলেন, আট বছর আগে তিনি পদোন্নতি প্রাপ্য হয়েছেন, এখনও তিনি পাননি। দুই-তিন হাজার টাকা দিয়ে যদি ন্যায্য অধিকার পান, তাহলে যে কয়েক হাজার টাকা বেতন বাড়বে, তাতে তো বাচ্চার দুধের খরচটা উঠবে। আর না পেলে তো পুরোটাই লস।এ প্রসঙ্গে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আনসার আলী খান সমকালের কাছে দাবি করেন, তিনি চাঁদা তুলতে স্বীকৃতি দেওয়া তো দূরের কথা, এটা তিনি জানেনও না। সিলেকশন গ্রেড না পাওয়ার বিষয়ে তিনি প্রথমে বলেন, এ ধরনের কোনো ঘটনা নেই। এক পর্যায়ে তিনি বলেন, আমার ওপর ভরসা রাখুন, এবার সিলেকশন গ্রেড হয়ে যাবে।
সিটি করপোরেশনের তদারককারী স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব শাহ কামাল সমকালকে বলেন, বর্তমানে তিনি সিটি করপোরেশন দেখছেন না। ডিএসসিসির কর্মচারীরা এ ধরনের কাজ করছে বলেও তার জানা নেই।বিষয়টি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারী সচিব সরোজ কুমার নাথের দৃষ্টিতে আনলে তিনি বলেন, পত্রিকায় নিউজ করে দেন। তাহলে টাকা তোলা বন্ধ হয়ে যাবে।