Boxed Style

আইফোন জিতে ক্লিক করুন

Wednesday 29 January 2014

বাংলা পঞ্জিকার সংশোধন ও জ্যোতির্বিজ্ঞান বর্ষপঞ্জি

অজয় রায়
পৌষ মাস হলো পিঠে-পুলি খাওয়ার মাস। কিছুদিন আগে হেমন্তের হিমেল মাস অগ্রহায়ণে নতুন চালের গন্ধে চারদিকের বাতাস কেমন ম-ম করে। পৌষ মাস ধরে আমাদের বাসায় চলত পিঠে তৈরির ধুমধাম পৌষসংক্রান্তি সামনে রেখে। সবটাই মার তত্ত্বাবধানে। আমার দুই পিসিমণি স্বর্ণলতা আর ধবলশ্রীকে আমন্ত্রণ জানানো হতো এই আয়োজনে শরিক হতে। আমার মনে আছে, সারা মাস ধরে আতপ-কাটারিভোগ চাল বাটা দিয়ে তৈরি হতো সরু চিক্কন চালের মতো সুচালো দানা। তাকে বলা হতো চুষি। এই সুচালো দানাগুলোকে মাসখানেক রোদে শুকানো হতো সযত্নে।

পৌষসংক্রান্তির দিন ঘন দুধ দিয়ে তৈরি হতো ওই চুষির পায়েস। অতি সুস্বাদু। অনেক সময় চিনির বদলে আখ বা খেজুরের গুড় ব্যবহার করা হতো রুচিমাফিক। এ ছাড়া নানা ধরনের পিঠে তৈরি করতেন মা-পিসিমারা। কত নাম! পাটিসাপ্টাই হতো নানা স্বাদের। কোনোটিতে ক্ষীরের পুর, কোনোটিতে নারিকেলের। আবার কোনোটিতে গুড়ের প্রলেপযুক্ত তাল শাঁস। কোনোটি মা তৈরি করতেন গাজর বা ছোলার হালুয়ার পুর দিয়ে। কোনোটিতে দিতেন ভেজিটেবলের পুর।
আর এক ধরনের পিঠে হতো, যার নাম ছিল 'পুয়া পিঠা'। চালের গুঁড়া দিয়ে গুড় মিশিয়ে গরম সরিষার তেলে ছেঁকে ভেজে তোলা হতো। চমৎকার স্বাদ। তৈরি হতো চিতুয়া পিঠা। এটি খাওয়ার উপাদান হলো আখের ঝোলাগুড়। অনেকে বানাত আগের দিনের রান্না করা বড় মাছ, বিশেষ করে বোয়াল মাছের জমাটবাঁধা তরকারি দিয়ে।
পৌষসংক্রান্তির একটি জ্যোতির্বৈদ্যিক দিক রয়েছে। সে সম্পর্কে খানিকটা আলোচনা করা প্রাসঙ্গিক হবে। পৌষসংক্রান্তির সরল অর্থ হলো পৌষ মাসের শেষ দিন। সংক্রান্তি মানে অতিক্রমণ। এর পরদিনই পহেলা মাঘ। ঋতু অনুযায়ী পৌষ হলো শীতারম্ভের মাস। বাংলা পঞ্জিকামতে, পৌষ-মাঘ এই দুই মাস শীতকাল (এ বছর ১৪২০ বঙ্গাব্দে পৌষ মাস ২৯ দিনের আর মাঘ মাসও ২৯ দিনের)। ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুযায়ী এই দুই মাস পড়ে ১৫ ডিসেম্বর ২০১৩ থেকে ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১৪।
বাংলাদেশের সংস্কারায়িত ক্যালেন্ডার অনুযায়ী পৌষ মাস সবসময় ৩০ দিনের। অতএব সংক্রান্তি হবে প্রতি বছর ৩০ পৌষ, ১৩ জানুয়ারি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে প্রচলিত হিন্দু পঞ্জিকা অনুযায়ী দিনটি ভিন্ন।
প্রায় শতবর্ষ আগে পণ্ডিত মাধব চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় অনুধাবন করেছিলেন, তার সময়কার প্রচলিত পঞ্জিকায় প্রদত্ত গ্রহসংস্থান আকাশে প্রকৃত অবস্থানের সঙ্গে মেলে না। তখনকার প্রসিদ্ধ সংস্কারবাদী পণ্ডিত উড়িষ্যার চন্দ্রসিংহ সামন্ত, সর্বজনপরিচিত লোকমান্য বাল গঙ্গাধর তিলক, পণ্ডিত বাপুদেব শাস্ত্রী ও কেততার, কাশীধামের সর্বজনশ্রদ্ধেয় পণ্ডিত মদনমোহন মালব্য, বাংলার মহামহোপাধ্যায় মহেশচন্দ্র ন্যায়রত্ন. শশধর তর্কচূড়ামণি, আচার্য যোগেশ চন্দ্র রায় বিদ্যানিধি প্রমুখ পণ্ডিতের পরামর্শক্রমে ইংরেজি ১৮৯০ (১২৯৭ বঙ্গাব্দ) সালে দৃকসিদ্ধ 'বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা' প্রথম প্রণীত হয়। দৃকসিদ্ধ বলতে আমরা বুঝব বিশেষ দৃষ্টিসম্পন্ন বা জ্ঞানসম্পন্ন, যার সঙ্গে অয়ন গতির সম্পর্ক রয়েছে। সূর্যসিদ্ধান্তভিত্তিক পঞ্জিকাকারগণ তাদের গণনায় নাক্ষত্রিক দিবস ব্যবহার করতেন ট্রপিক্যাল দিবসের পরিবর্তে।
এরপর ১৯০৪ সালে জগদগুরু শঙ্করাচার্যের সভাপতিত্বে বোম্বাই শহরে অধ্যাপক প্রবোধচন্দ্র সেনগুপ্ত, আশুতোষ মিত্র এবং পণ্ডিত শশধর তর্কচূড়ামণি ও অন্যান্য প্রখ্যাত শাস্ত্রবিদ ও পণ্ডিতের উপস্থিতিতে পঞ্জিকা সংস্কারের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৩৩২ বঙ্গাব্দে বঙ্গীয় ব্রাহ্মণসভার সভাপতি মহামহোপাধ্যায় গুরুচরণ তর্কদর্শনতীর্থ মহাশয়ের উদ্যোগে এবং পুরুষসিংহ আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে এক মহতী সভায় 'দৃকগণিতৈকা' পঞ্জিকা প্রণয়নের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। দক্ষিণ ভারতের মাদ্রাজ শহরে কালহাড্ডি, রাজমুন্দ্রী এবং কাঞ্চিপুরম শহরে পঞ্জিকা প্রণয়নের জন্য আলোচনা সভার মাধ্যমে সর্বত্রই দৃকসিদ্ধান্ত মতানুযায়ী পঞ্জিকা প্রণয়নের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এতদ্ব্যতীত ভারতবর্ষে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে আয়োজিত দৃকসিদ্ধান্ত মতানুযায়ী পঞ্জিকা গণনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
অবশেষে ভারত সরকার এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহরু ১৯৫২ সালে ভারতে প্রচলিত এবং আন্তর্জাতিক গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের সংস্কার সম্বন্ধে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। তার উক্তিটি উদ্ধৃত করছি :'ঞযব ঢ়ৎবংবহঃ পড়হভঁংরড়হ রহ ড়ঁৎ পধষবহফধৎ রহ ওহফরধ ড়ঁমযঃ ঃড় নব ৎবসড়াবফ. ও যড়ঢ়ব ড়ঁৎ ংপরবহঃরংঃং রিষষ মরাব ধ ষবধফ রহ ঃযরং সধঃঃবৎ.' (ঊীঃৎধপঃ ভৎড়স সবংংধমব মরাবহ নু ঘবযৎঁ রহ ঃযব রহধঁমঁৎধষ সববঃরহম ড়ভ ঃযব ঈধষবহফধৎ জবভড়ৎস ঈড়সসরঃঃবব যবষফ রহ ঘব িউবষযর রহ ১৯৫৩). 'ঈধষবহফধৎ জবভড়ৎস ঈড়সসরঃঃবব.'
বস্তুত নেহরু ভারতীয় বিজ্ঞানীদের প্রতি পঞ্জিকা সংস্কার সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানিয়ে ১৯৫৩ সালে 'ঈধষবহফধৎ জবভড়ৎস ঈড়সসরঃঃবব' নামে একটি কমিটি গঠন করেন। বিশ্বখ্যাত জ্যোতিঃপদার্থবিদ অধ্যাপক এমএন সাহা, এফআরএস এমএনএকে ওই কমিটির সভাপতি এবং প্রখ্যাত গণিতজ্ঞ ও জ্যোতির্বিদ নির্মলচন্দ্র লাহিড়ীকে সম্পাদক নিযুক্ত করেন। ড. সাহা ওই কমিটির উদ্বোধনী সভায় বলেছিলেন :ওহ ওহফরধ, ঃযব রফবধ ড়ভ ওহফরধহ ঈধষবহফধৎ ৎবভড়ৎস ড়ৎরমরহধঃবফ ভৎড়স গধযধৎধংঃৎধ. খড়শসধহুধ ইধষধ এধহমধফযধৎ ঞরষধশ, বিষষশহড়হি ধং ধহ বসরহবহঃ ঢ়ড়ষরঃরপধষ ভরমঁৎব ড়ভ ঃযব ষধংঃ মবহবৎধঃরড়হ, ধিং ধষংড় ধ মৎবধঃ ংপযড়ষধৎ ধহফ যব রহরঃরধঃবফ পধষবহফধৎ ৎবভড়ৎস রহ গধযধৎধংঃৎধ, ংঃধৎঃরহম ধ হব িৎবভড়ৎসবফ পধষবহফধৎ রহ ১৯০৪ যিরপয রং ংঃরষষ নবরহম ভড়ষষড়বিফ রহ ঃযব ধহহঁধষ ধষসধহধপং ঢ়ঁনষরংযবফ রহ চড়ড়হধ.
বঙ্গদেশে মাধব চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সেই ১৮৯০ সাল থেকে 'বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা' প্রকাশ করে আসছিলেন, যেখানে তিনি তার গণনায় আধুনিককালে ব্যবহৃত সূত্রগুলো ব্যবহার করেছেন। নির্মল চন্দ্র লাহিড়ীও তার গণনাকার্য চালিয়ে যাচ্ছেন। পুরাকাল থেকেই ভারতীয় সংস্কৃতি ও ধর্মচর্চার পীঠস্থান কাশীধামের পণ্ডিত প্রয়াত মদনমোহন মালব্য ও তার সহকর্মী স্বরূপানন্দও আধুনিক তথ্যের আলোকে ভারতীয় পঞ্জিকা সংস্কারের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। এই কমিটি ১৯৫৫ সালে ভারতের জন্য একটি জাতীয় পঞ্জিকা ও দৃকসিদ্ধান্ত গণনা অনুযায়ী পঞ্জিকা রচনার সুপারিশ করে এবং ভারতীয় সরকার তা গ্রহণ করে।
উল্লেখ করা হয়েছে, পৌষসংক্রান্তি বস্তুত সব সংক্রান্তিরই একটি জ্যোতির্বৈদ্যিক দিক আছে। ইতিপূর্বে বলেছি, সংক্রান্তি কথাটির অর্থ হলো অতিক্রম করা বা অতিক্রমণ। বিশেষ অর্থ হলো, সূর্য যখন এক রাশি থেকে অন্য রাশিতে প্রবেশ করে তাকেই বলা হয় সংক্রান্তি। চলতি কথায়, মাসের শেষ দিবসকেই বলা হয় সংক্রান্তি। পৌষ মাসের শেষ দিনটিকে তাই বলা হয় 'পৌষসংক্রান্তি', আর চৈত্রের শেষ দিবস অভিহিত হয় চৈত্রসংক্রান্তি নামে। চৈত্রের শেষ দিবসকে পঞ্জিকাকাররা বলে থাকেন 'মহাবিষুব' সংক্রান্তি। সাধারণত এটি ঘটে থাকে ২১ মার্চ। আশ্বিনের শেষ দিন হলো 'জলবিষুব' সংক্রান্তি। আর এটি পড়ে ২৩ সেপ্টেম্বর তারিখে। তাই ২২ মার্চ আর ২৩ সেপ্টেম্বর এই দুই তারিখে দিন-রাত্রি সমান। সূর্য তখন বিষুববৃত্তে লম্বভাবে অবস্থান করে।
মহাকাশে পৃথিবীর অক্ষরেখার ওপর লম্বভাবে অঙ্কিত মহাবৃত্তের নাম বিষুববৃত্ত। আর মহাকাশে পৃথিবীর চারপাশে সূর্যের আপাত বার্ষিক গতিপথকে বলা হয় 'রবি মার্গ' বা রাশিচক্র। এই দুটি মহাবৃত্ত একই সমতলে অবস্থান করে না। তারা পরস্পরকে দুটি বিন্দুতে ছেদ করে এবং উভয়ের মধ্যে ২৩০২৭' কোণ রচিত হয়। এই ছেদ বিন্দু দুটির নাম যথাক্রমে মহাবিষুব বিন্দু ম এবং জলবিষুব বিন্দু ড। পৃথিবীর মেরুঅক্ষ ক্রান্তি তলের অক্ষের সঙ্গে ২৩০২৭' হেলে থাকে বলেই বিষুববৃত্ত ও ক্রান্তিবৃত্ত পরস্পরকে ছেদ করে। এ কারণেই পৃথিবীতে ঋতুর পরিবর্তন হয়। সাধারণভাবে ২২ মার্চ তারিখে সূর্য ক্রান্তিবৃত্ত ও বিষুববৃত্তের মধ্যে ছেদ ম বিন্দুকে অতিক্রম করে। আর তাই ২২ মার্চ তারিখে পৃথিবীর সর্বত্র দিন-রাত্রি সমান হয়। কারণ এ সময় সূর্য বিষুববৃত্তে অবস্থান করে। এর পর থেকেই উত্তর গোলার্ধে দিন বাড়তে থাকে আর রাত ছোট হতে থাকে এবং ২১ জুন তারিখে উত্তর গোলার্ধে আমরা পাই দীর্ঘতম দিন আর হ্রস্বতম রজনী। সূর্য এ সময় কর্কট ক্রান্তিবৃত্তে অবস্থান করে। ক্রান্তিবৃত্তে সূর্যের এই প্রান্তিক অবস্থান বিন্দুকে বলা হয় উত্তর অয়নান্ত বা কর্কট ক্রান্তি। দক্ষিণ গোলার্ধে অবশ্য এর বিপরীত। এরপর থেকে দিন ছোট হতে থাকে আর রাত বড় হতে থাকে। অবশেষে ২৩ সেপ্টেম্বর তারিখে সূর্য পুনরায় অবস্থান নেয় বিষুববৃত্তের ড বিন্দুতে, যেখানে ক্রান্তিবৃত্ত ও বিষুববৃত্ত পরস্পরকে ছেদ করেছে। একে বলা হয় 'জলবিষুব বিন্দু'। এ দিন পুনরায় পৃথিবীর সর্বত্র দিন-রাত সমান হয়ে থাকে। অতঃপর উত্তর গোলার্র্ধে ক্রমশ রাত বড় হতে হতে সূর্য পেঁৗছে যায় ক্রান্তি বৃত্তের দক্ষিণ অয়নান্ত বিন্দুতে ২২ ডিসেম্বর তারিখে যখন উত্তর গোলার্ধে হয় দীর্ঘতম রজনী আর ক্ষুদ্রতম দিবস। এ সময় সূর্য মকরবৃত্তে অবস্থান করে থাকে। তাই সূর্যের এই অবস্থানকে বলা হয় মকরক্রান্তি। এখানে লক্ষণীয়, ২১ জুনের পর থেকে সূর্য রাশিচক্রে ক্রমশ দক্ষিণ দিকে সরে আসতে আসতে ডিসেম্বর মাসে দক্ষিণতম বিন্দুতে (মকরক্রান্তি বিন্দু) উপনীত হয়। সূর্যের এই ছয় মাসব্যাপী দক্ষিণ অভিমুখী অভিযাত্রাকে বলা হয়ে থাকে দক্ষিণায়ন। অন্যদিকে ২২ ডিসেম্বরের পর থেকে সূর্য পুনরায় রাশিচক্রে ক্রমশ উত্তরদিকে সরতে সরতে জুন মাসে উত্তরতম বিন্দুতে উপনীত হয় (কর্কটক্রান্তি বিন্দূ)। সূর্যের এই ছয় মাসব্যাপী উত্তরাভিযানকে বলা হয় উত্তরায়ন।
এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয়, জ্যোতির্বিজ্ঞান অনুযায়ী সূর্য রাশিচক্রে চারটি কার্ডিনাল বিন্দুতে_ মহাবিষুব সংক্রান্তি, জলবিষুব সংক্রান্তি, উত্তর অয়নান্ত বিন্দু এবং দক্ষিণ অয়নান্ত বিন্দুতে উপনীত হয় যথাক্রমে ২১ মার্চ, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২১ জুন ও ২২ ডিসেম্বর তারিখে।
কিন্তু বাংলা পঞ্জিকাকারগণ যে তারিখগুলোকে এই দিবসগুলোকে চিহ্নিত করেন; তার সঙ্গে জ্যোতির্বিজ্ঞানসম্মত ওই তারিখগুলোর একদম মিল নেই। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে। আমার হাতের কাছে বেণীমাধব শীলের ১৪২০ সালের পঞ্জিকাটি রয়েছে। এই পঞ্জিকা অনুযায়ী চৈত্র মাস ৩০ দিন (ইংরেজি তারিখ ১৪ এপ্রিল ২০১৪)। দিবসটিকে 'মহাবিষুব সংক্রান্তি' নামে অভিহিত করা হয়েছে। অথচ আসল মহাবিষুব সংক্রান্তি হয় ২১ মার্চ। দেখা যাচ্ছে, ২২ দিনের ব্যবধান। অন্যদিকে হিন্দু পঞ্জিকা অনুযায়ী, পৌষসংক্রান্তি হলো পৌষ মাসের শেষ দিন, যেমন ১৪২০ সালের বেণীমাধব শীলের পঞ্জিকানুযায়ী পৌষ মাস ২৯ দিনের। অতএব, ১৪২০ বঙ্গাব্দে পৌষসংক্রান্তি হবে ২৯ পৌষ (১৪ জানুয়ারি)। পৌষসংক্রান্তি হলো মকরসংক্রান্তি। কারণ সূর্য তখন মকরবৃত্তে অবস্থান করে। একে উত্তরায়ন সংক্রান্তিও বলা হয়। কারণ সূর্য তার উত্তরমুখী অভিযানে বা উত্তরায়নে শেষ বিন্দুতে উপনীত হয়। যদিও প্রকৃত জ্যোতির্বিদ্যা অনুযায়ী তারিখটি আসলে ২২ ডিসেম্বর। এখানেও দেখা যাচ্ছে, হিন্দু পঞ্জিকাকারগণ দক্ষিণ অয়নান্ত বিন্দুটিকে ২২ দিন পিছিয়ে দিয়েছেন। অর্থাৎ তাদের হিসাব অনুযায়ী অয়নান্ত ঘটবে ২৯ পৌষ বা ১৪ জানুয়ারিতে। গত বছরের ১৪১৯ নবযুগ পত্রিকায় উলি্লখিত ওই তারিখগুলো পর্যালোচনা করে আমরা একই সিদ্ধান্তে উপনীত হই। গত বছরের (১৪১৯) ওই পঞ্জিকা অনুযায়ী পৌষসংক্রান্তি হবে ২৯ পৌষ (১৪ জানুয়ারি ২০১৩), যাকে বলা হয়েছে মকর বা উত্তরায়ন সংক্রান্তি। আর তাদের হিসাব অনুযায়ী চৈত্রসংক্রান্তি পড়েছে ৩১ চৈত্র (১৪ এপ্রিল ২০১৩)। এই দিনটিকে তারা অভিহিত করছেন 'মহাবিষুব সংক্রান্তি' নামে। এই বিভ্রান্তির কারণ পঞ্জিকাকারগণ তাদের গণনায় নক্ষত্র বছর ব্যবহার করে থাকেন (যেখানে অয়ন বিন্দুদ্বয়ের গতিকে হিসাবে আনা হয় না) ক্রান্তি বছরের পরিবর্তে। বর্তমান হিসাবমতে, ম বিন্দুটি কোনো স্থির নক্ষত্রের সাপেক্ষে সূর্যের গতির উল্টোদিকে সরে আসছে। ফলে ম বিন্দুটির সাপেক্ষে সূর্যের আপাত অবস্থানের মধ্যে ও পঞ্জিকার হিসাবে সূর্যের অবস্থানের মধ্যে দূরত্ব বেড়েই চলেছে। যদি ধরা হয় যে, ৫৭০ অব্দে সিদ্ধান্তিক গণনা চালুকালে মহাবিষুব সংক্রান্তি হয়তো ৩০ বা ৩১ চৈত্র হতো। অয়ন বিন্দুর এই পশ্চাদ্গামিতার ফলে এখন প্রকৃত মহাবিষুব সংক্রান্তি ঘটে থাকে ৭ বা ৮ চৈত্র (২২ মার্চ)। হিসাব করে দেখা গেছে, পঞ্জিকার এই গণনা পদ্ধতি অব্যাহত থাকলে আগামী ২০০০ বছরের মধ্যে আমরা যথাযথ ঋতু থেকে এক মাস এগিয়ে যাব। অর্থাৎ যেসব অনুষ্ঠান হওয়ার কথা বসন্তকালে, তা পড়বে মধ্যশীতে। সূর্যসিদ্ধান্তভিত্তিক পণ্ডিত পঞ্জিকাবিশারদগণ কি আধুনিক বিজ্ঞানের অবদানকে অস্বীকার করেই যাবেন, আর তাদের অনুসারী সাধারণ মানুষদের মধ্যে বিভ্রান্তি বাড়াতেই থাকবেন? আমাদের একজন প্রগতিবাদী, বিজ্ঞানমনস্ক বিদ্যাসাগরের জন্য আর কতকাল অপেক্ষা করতে হবে?
শিক্ষাবিদ