Boxed Style

আইফোন জিতে ক্লিক করুন

Sunday 3 November 2013

ইয়াবা সিন্ডিকেটে ১৩৬ জন

ইয়াবা সিন্ডিকেটে ১৩৬ জন
সারোয়ার সুমন ও নোমান আবদুল্লাহ, চট্টগ্রাম
জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ বিষয়ক দফতর (ইউএনওডিসি) ২০১৩ সালে প্রকাশিত একটি রিপোর্টে উল্লেখ করে, ২০০৯ সালে বাংলাদেশে ভয়ঙ্কর মাদক ইয়াবা ধরা পড়ে এক লাখ ৩০ হাজার পিস। তবে ২০১০ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় আট লাখ ১২ হাজার। আবার বছর না ঘুরতেই ২০১১ সালে ইয়াবা আটকের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৪ লাখ পিস! হঠাৎ করে ইয়াবার এমন বিস্তৃতির নেপথ্যের কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে পাওয়া গেছে পিলে চমকানো তথ্য। টেকনাফের সরকারদলীয় সাংসদ আবদুর রহমান বদির পরিবার ও স্বজনদের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে ইয়াবা ব্যবসায়। তাদের ছত্রছায়ায় সারাদেশে ইয়াবা ছড়িয়ে দিচ্ছে ১৩৬ সদস্যের বিশেষ একটি সিন্ডিকেট। এর একটি অংশ মিয়ানমার থেকে ইয়াবা পেঁৗছে দিচ্ছে টেকনাফে। আরেকটি অংশ টেকনাফ থেকে ইয়াবা ছড়িয়ে দিচ্ছে সারাদেশে। অপর অংশটি ইয়াবা উৎপাদন ও বিপণন পর্যায়ে আইনি কোনো সমস্যা হলে লগি্ন করছে অর্থ! বিজিবি এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ইয়াবা সিন্ডিকেটের তালিকায় রয়েছে এমপি বদি পরিবারের অনেক সদস্যের নাম।
এ ব্যাপারে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ ইকবাল সমকালকে বলেন, 'ইয়াবার গডফাদার হিসেবে এমপি বদি পরিবারের সম্পৃক্ত থাকার তথ্য আমাদের কাছেও এসেছে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের দেওয়া ইয়াবা ব্যবসায়ীদের তালিকায়ও এমপি পরিবারের অনেকের নাম আছে। তবে পূর্ণাঙ্গ ডাটা ও ছবি না থাকায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারছি না।'
তবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দাবি অস্বীকার করছেন সাংসদ আবদুর রহমান বদি। তিনি বলেন, 'ইয়াবা ব্যবসাকে আমি ঘৃণা করি। আমি কিংবা আমার পরিবারের কেউই ইয়াবা ব্যবসায় সম্পৃক্ত নই। আমরা পারিবারিকভাবে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। আমাদের রয়েছে সিআইপি পদমর্যাদাও।
সর্বশেষ অর্থবছরে কক্সবাজার জেলা থেকে সর্বোচ্চ কর দিয়ে পুরস্কৃতও হয়েছি আমি। তার পরও একটি চক্র আমাদের পরিবারের সুনাম নষ্ট করতে ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে আমাদের নাম জড়াচ্ছে। রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে এটি ওই চক্রের একটি অপকৌশল।' অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'কোন ভাই কী করে তার দায় তো আমার হতে পারে না। আমাদের ব্যবসা আলাদা।'
এমপি বদি এমনটি দাবি করলেও ২০১৩ সালের ১ এপ্রিল বিজিবি তাদের রিপোর্টে যে সাতটি গাড়ি ইয়াবা সরবরাহের কাজে ব্যবহৃত হয় বলে উল্লেখ করেছে, তার মধ্যে দুটি গাড়ির মালিক বদির ছোট ভাই আবদুল আমিন ও আবদুল শুক্কুর। এ দুটি গাড়ির একটি কালো ও আকাশি রঙের এফ প্রিমিও মডেলের কার। অপরটি কালো রঙের ল্যান্ডক্রুজার জিপ। এসব গাড়িতে একাধিক ভুয়া নাম্বার প্লেট ব্যবহার করে ইয়াবা পাচার হওয়ায় এগুলোকে আইনের আওতায় আনা যাচ্ছে না বলে এ প্রতিবেদনে উল্লেখ করে বিজিবি।
ইয়াবা ব্যবসায় এমপি পরিবারের কানেকশন
টেকনাফের আলোচিত-সমালোচিত স্থানীয় সাংসদ আবদুর রহমাদ বদির নাম উঠে আসছে ইয়াবার ভয়ঙ্কর বাণিজ্যে। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের গোপনীয় রিপোর্টেও আছে এমপি বদির তিন ভাইয়ের নাম। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো রিপোর্টেও উঠে এসেছে ইয়াবা বাণিজ্যে বদি পরিবারের কানেকশনের কথা। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযোগ, বাংলাদেশে ইয়াবা সরবরাহের সঙ্গে জড়িত রয়েছে এমপির তিন আপন ভাই, দুই সৎ ভাই, আপন ভাগ্নে, দুই বেয়াই ও ব্যক্তিগত সহকারী। এমপি বদির আপন ভাই মো. আবদুল শুক্কুর, মজিবুর রহমান ওরফে মুজিব কমিশনার, আবদুল আমিন, ফয়সাল রহমান, এমপির ভগি্নপতি আবদুর রহমানের ছেলে নিপু, এমপির তালতো ভাইয়ের ছেলে আকতার কামাল ও শাহেদ কামাল। এমপির ডান হাত হিসেবে পরিচিত জাহেদ হোসেন জাকু, এমপির ফুফা হায়দার আলী ও তার ছেলে কামরুল ইসলাম রাসেল। বদি ছাড়াও আরেকটি সিন্ডিকেট এখানে সক্রিয় রয়েছে। এ সিন্ডিকেটের নেতৃত্ব দেন ডা. হানিফের ছেলে হাজী সাইফুল করিম ও তার ভাই জিয়া ওরফে জেড করিম। জাবেদ ইকবাল ও ছাত্রনেতা আলী আহমদ এই সিন্ডিকেটের অন্যতম সহযোগী ।
ইয়াবা সিন্ডিকেটে আরও যারা
লেংগুরবিল গ্রামের মৃত সুলতান আহাম্মদের ছেলে মো. জাফর আলম, চৌধুরীপাড়া গ্রামের মৃত অং সেন তা'র ছেলে মং মং সেন, শফিউর রহমানের ছেলে মো. আলম, কাইয়ুকখালীপাড়া গ্রামের মৃত আবদুস সাত্তারের ছেলে মো. একরামুল হক, চৌধুরীপাড়া গ্রামের মোজাহার কোম্পানির ছেলে মো. আলম, কুলারপাড়া গ্রামের সোনালির ছেলে মো. গিয়াস উদ্দিন, মৃত আবদুল মজিদের ছেলে আমিন ওরফে বুল কমিশনার, সামছুল হকের ছেলে আফসার, চৌধুরীপাড়া গ্রামের মৃত জালালের ছেলে ছলিম, পুরাতন পল্লানপাড়া গ্রামের নজরুল ইসলামের ছেলে শাহ আলম, বশিরের ছেলে রেদোয়ান, নাজিরপাড়া গ্রামের হাজি ইসলামের ছেলে জিয়াউর রহমান, হাজি খোলা মিয়ার ছেলে সৈয়দ আলম, মৃত এজাহার মিয়ার ছেলে হাসু মিয়া, মৌলভীপাড়া গ্রামের হাজি ফজল আহাম্মদের দুই ছেলে আবদুর রহমান ও মো. একরাম, মৃত নুরুল হকের ছেলে আবদুল গনি, নয়াপাড়া গ্রামের মৌলভী আলী হোসেনের ছেলে সামছুল আলম মার্কিন, মণ্ডলপাড়া গ্রামের মোকতার হোসেনের ছেলে মাসুল মেম্বার, নয়াপাড়া গ্রামের দুদু মিয়ার ছেলে মৌলভী ওসমান সরোয়ার, হারিয়াখালী গ্রামের নুর আহম্মদের ছেলে কবির মেম্বার, ডেকিরারবিল গ্রামের মৌলভী মৃত আবদুল হামিদের ছেলে মৌলভী শফিউল্লা, হারিয়াখালী গ্রামের আবদুল বারির ছেলে আবদুল হামিদ, সাবরাং বাজারপাড়া গ্রামের এএসপি আবদুর রহমানের ছেলে নিপু, নয়াপাড়া গ্রামের মৃত সৈয়দ আহম্মদের ছেলে মৌলভী মো. ইয়াহিয়া, কচুবুনিয়া গ্রামের আবদুল হকের ছেলে মৌলভী কবির, খানকারপাড়া গ্রামের মৃত হান্নানের ছেলে মৌলভী বোরহান, সোনা মিয়ার ছেলে মৌলভী নুর মোহাম্মদ, মৃত নুর আহাম্মদের ছেলে ইব্রাহীম খলিল, উত্তরপাড়া গ্রামের মৃত নজির আহম্মেদের ছেলে সৈয়দ আলম, জাদিমোড়া গ্রামের মৃত আবুল হাসেমের ছেলে আব্বাস, হ্নীলা গ্রামের মৃত সুলতান খলিফার ছেলে লিয়াকত সওদাগর, চৌধুরীপাড়া গ্রামের হাজি ইসমাইলের ছেলে ইসলাম জালিয়াপাড়া গ্রামের মৃত আমৃক্তার আহম্মদের ছেলে ফরিদ আলম, চৌধুরীপাড়া গ্রামের হাজি ইসমাইলের ছেলে নুর আলম, জালিয়াপাড়া গ্রামের আংগু, হাসেমের ছেলে হাসান আলী, মৃত আলী আকবরের ছেলে ইলিয়াছ, ইলিয়াসের ছেলে সাকের, খুরা মাসুমের ছেলে রেজা, গোলাম মাহামুদের মেয়ে সামছুর নাহার জৈতি, কাইকখালীপাড়া গ্রামের গুরা মিয়া সওদাগরের ছেলে সৈয়দ আলম, দক্ষিণ জালিয়াপাড়া গ্রামের পুতন মিয়ার ছেলে মোহাম্মদ আলী, খানকারপাড়া গ্রামের রজব মেম্বারের ছেলে রেজাউল করিম, ডেইলপাড়া গ্রামের মোতালেবের ছেলে সাইফুল ইসলাম, নাইটংপাড়া গ্রামের বশির আহম্মেদের ছেলে আইয়ুব, মৃত ইউসুফের ছেলে তৈয়ব মিয়া, নুরুল হকের ছেলে পিচ্চি আনোয়ার, রহিম উদ্দিনের ছেলে জামাল, সিদ্দিকের দুই ছেলে আনোয়ার ও নুর মোহাম্মদ, আবদুর শুকুরের ছেলে মোন্নাফ, মৃত ওবায়দুর রহমানের ছেলে সামসুল আলম, মৃত জালাল আহম্মেদের ছেলে সৈয়দ আলম, মৃত সামছুর ছেলে ফরিদ আলম, লালু মিয়ার ছেলে রফিক, এজাহার মিয়ার ছেলে মাহামুদুল হক, জালিয়াপাড়া গ্রামের দিলু মিয়ার ছেলে সৈয়দ আলম, উত্তর লম্বারীর ছেলে নুরুল ইসলামের ছেলে কামাল হোসেন, চৌধুরীপাড়া গ্রামের মৃত এজাহার মিয়ার ছেলে জহির, নাজিরপাড়া গ্রামের গনি মিয়ার ছেলে জাফর, মৃত আলী আহম্মদের ছেলে আবদুর রহমান, ইসলামাবাদ গ্রামের সৈয়দুর রহমানের ছেলে ছোটন, কবির আহম্মদের ছেলে আবদুর রাজ্জাক, ডেইলপাড়া এলাকার শরিফ হোসেনের ছেলে আবদুল্লাহ, মনুপাড়া গ্রামের নুর মোহাম্মদের ছেলে জাকির হোসেন, মৌলভীপাড়া গ্রামের মৃত লাল মিয়ার ছেলে আবুল কালাম (কালা মিয়া), হাজি কালা মিয়ার ছেলে আলী, মোকলেছুর রহমানের ছেলে ফরিদ, নাজিরপাড়া গ্রামের হাজি সুলতান আহাম্মদের ছেলে হাজি মোহাম্মদ ইসলাম ও রফিক, সালে আহম্মদের ছেলে সরোয়ার হোসেন, দুলু ড্রাইভারের ছেলে আবদুল্লাহ শাহ, আবদুল করিমের ছেলে ইলিয়াছ, লাল মোহাম্মদের ছেলে বিল্লাল, নুরু প্রকাশ পিচ্চি নুরু, চান মিয়া, কুলালপাড়া গ্রামের সামছুর ছেলে নুরুল হক, জালিয়াপাড়া গ্রামের সৈয়দ হোসেনের ছেলে আবদুল আলী, গোলাপাড়া গ্রামের আবদুর রহমান ড্রাইভারের ছেলে শফিক, নয়াপাড়া গ্রামের মৌলভী আলী হোসেনের ছেলে আবদুল গফুর, সুলতান আহম্মেদের ছেলে ফারুক, শাহপরী দ্বীপের জালিয়াপাড়া গ্রামের এজাহার হোসেনের ছেলে নুর আলম, জাদিমোড়া গ্রামের আলম, দমদমিয়া গ্রামের রমজান আলীর ছেলে জাহাঙ্গীর, পানখালী গ্রামের নুর আহম্মেদের হোসেন আহম্মেদ, মগপাড়া গ্রামের খায়রুল বাসারের ছেলে জাকির ও সৈয়দ আলম, হোয়াইকং গ্রামের আবদুল হাকিমের ছেলে বাবুল, তৈয়ম গোলালের ছেলে সৈয়দ আলম ও মাত আলম, মৃত সুলতানের ছেলে শাহ আলম, মৃত জাফর আলীর ছেলে ছফর আলী, বনি আমিনের ছেলে জসিম, আলতাজের ছেলে হেলাল, মৃত মনু মিয়ার ছেলে তোফায়েল ও সোহেল রানা, নাজিরপাড়া গ্রামের ইসলামের ছেলে জিয়াউর রহমান, ছাগল হাসু এবং পোয়া চান মিয়া।
স্থানীয়রা যা বলেন
এমপি বদি পরিবারের সঙ্গে ইয়াবা কানেকশন থাকার কথা স্বীকার করে টেকনাফ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী বলেন, 'দেশের সর্বোচ্চ জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে যদি মাদক ব্যবসার অভিযোগ ওঠে সেটা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্য ছাড়া কিছু নয়। অভিযোগ ওঠাটাকেও আমি অপরাধ মনে করি। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ইয়াবা ব্যবসা বন্ধ করার ব্যাপারে চাপ দিলে তারা বলেন, এমপি সাহেবের লোকজন ফোন করে আসামি ছাড়িয়ে নেন। আমাদের কেন দোষ দেন?' একই প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ দলীয় উপজেলা চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শফিক মিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি সরাসরি কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।