Wednesday, 25 December 2013

ছিল ২০ একর হয়েছে ২৮৬৫ একর জমি

 
মাহবুবুর রহমান
মাহবুবুর রহমান ছিলেন পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী। কিন্তু মন্ত্রী হওয়ার পর তিনি বিপুল পরিমাণ সম্পদ করেছেন মূলত জমিতে। মাত্র পাঁচ বছরে তাঁর ব্যাংকে টাকা বেড়েছে ৫৮৬ গুণ, জমি বেড়েছে ১৪৩ গুণ এবং বার্ষিক আয় বেড়েছে ৭৯ গুণ।
পটুয়াখালী-৪ (কলাপাড়া ও রাঙ্গাবালী) আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত সাবেক এই প্রতিমন্ত্রীর পাঁচ বছর আগে কৃষিজমি ছিল মাত্র ২০ একর। আর এখন সেই জমির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে দুই হাজার ৮৬৫ একর। অর্থাৎ এই পাঁচ বছরে তিনি দুই হাজার ৮৪৫ একর জমির মালিক হয়েছেন।
২০০৮ সালে নির্বাচনের আগে মাহবুবুর রহমানের বার্ষিক আয় ছিল দুই লাখ ১৫ হাজার টাকা। এবার তাঁর বার্ষিক আয়ের মধ্যে কেবল মৎস্য উৎপাদন ও বিক্রি থেকেই এসেছে দেড় কোটি টাকা। চাকরি থেকে বার্ষিক আয় ২০ লাখ ৩৪ হাজার ৭০০ টাকা। আর তাঁর নির্ভরশীলদের আয় তিন লাখ ৯৫ হাজার টাকা।

পাঁচ বছর আগে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে মাহবুবুর রহমানের জমা টাকা ছিল ৮৩ হাজার ১১২ টাকা। আর স্ত্রীর নামে বিভিন্ন সঞ্চয়পত্রে বা স্থায়ী আমানতে বিনিয়োগ ছিল পাঁচ লাখ টাকা। গাড়ি ছিল দুটি। এ ছাড়া স্বর্ণ ২০ তোলা, ইলেকট্রনিক সামগ্রী এক লাখ টাকা ও আসবাবপত্র এক লাখ টাকার।
মাত্র পাঁচ বছরে সব কিছুই ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। এখন তাঁর নিজের নামে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমাই আছে চার কোটি ৮৭ লাখ ৬৬ হাজার ৭৮২ টাকা। স্ত্রীর নামে জমা আছে ৩০ লাখ ৮৫ হাজার ৬৫৮ টাকা। বিভিন্ন সঞ্চয়পত্রে বা স্থায়ী আমানতে স্ত্রীর নামে বিনিয়োগ আছে ১৬ লাখ ১৪ হাজার ৩৪২ টাকা। মাহবুবের ব্যবসায় নিজের পুঁজি ৩৫ লাখ ও স্ত্রীর ৭৬ লাখ ৭১ হাজার।
গেলবার তাঁর কৃষিজমি ছিল ২০ একর। আর অকৃষি জমি (রাজউক থেকে বরাদ্দ) ছিল পাঁচ কাঠা জমি। ১০ শতাংশ জমির ওপর বাড়ির চার ভাগের এক ভাগ ছিল তাঁর। ঋণ ছিল তিন লাখ ২০ হাজার ৩৫২ টাকা।
কিন্তু আলাদিনের চেরাগ দিয়ে পাঁচ বছরেই মাহবুব ২০ একর কৃষি জমি থেকে দুই হাজার ৮৬৫ একর জমির মালিক হয়েছেন তিনি। এবার তাঁর অকৃষি জমির পরিমাণ ৬ কাঠা ১৩ ছটাক। যৌথ মালিকায় ১০ শতাংশ জমির ওপর একটি ও এক একর জমির ওপর আরেকটি বাড়ির চার ভাগের এক ভাগের মালিক তিনি। এবার তাঁর দায় আছে দেড় কোটি টাকা।
মাহবুবের নিজের ও স্ত্রীর মিলে স্বর্ণসহ অলংকারাদি আছে দুই লাখ টাকার। ইলেকট্রনিক সামগ্রীর দুজনের দুই লাখ, আসবাবপত্রও একই, দুই লাখ টাকার। হলফনামায় তিনি বলেছেন, জনৈক বিপুল হাওলাদারের কাছ থেকে ধার নিয়েছেন ৫০ লাখ টাকা ও শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক থেকে নিয়েছেন আরও এক কোটি টাকা।
এ বিষয়ে বক্তব্য নেওয়ার জন্য মাহবুবুর রহমানের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে অপরপ্রান্ত থেকে বিষয়বস্তু জানতে চাওয়া হয়। পরে বিষয়বস্তু বলার পর অপরপ্রান্ত থেকে বলা হয়, হলফনামায় যা দেওয়া আছে, তা তো লিখিতভাবে দেওয়া আছে। এ পর্যায়ে নিজেকে মাহবুবুর রহমানের একান্ত সচিব আরিফ বলে পরিচয় দিয়েই লাইন কেটে দেওয়া হয়।
এই প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন কলাপাড়া প্রতিনিধি

স্বামী-স্ত্রীর নগদ টাকাই আছে পাঁচ কোটি

মহীউদ্দীন খান আলমগীরসাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর শেষ সময়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হয়েছিলেন। মন্ত্রিত্ব ছাড়াও পেয়েছেন ব্যাংক, বিশ্ববিদ্যালয় ও কনটেইনারবাহী জাহাজের লাইসেন্স। এরই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে তাঁর সম্পদও।
২০০৮ সালে মহীউদ্দীন খান আলমগীরের নামে ১৩টি মামলা ছিল। কিন্তু প্রায় সব মামলা থেকেই অব্যাহতি পেয়েছেন। ১৯৯৬ সালে জনতার মঞ্চে একজন সরকারি কর্মকর্তা হয়ে সে সময়ের আন্দোলনরত বিরোধী দল আওয়ামী লীগের পক্ষ নিয়ে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিলেন। এর পরই তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতিতে নামেন।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় অবৈধ সম্পদ অর্জনের দায়ে ১৩ বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল মহীউদ্দীন খান আলমগীরের। সংসদ সদস্য পদও হারাতে বসেছিলেন। নির্বাচন কমিশন মহীউদ্দীন খান আলমগীরের চাঁদপুর-১ আসন শূন্য ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করেছিল। পরে এর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে তিনি হাইকোর্টে রিট করলে শুনানি শেষে আদালত ওই গেজেট এখতিয়ারবহির্ভূত ও অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। ফলে তিনি সাংসদ হিসেবে বহাল থাকেন।
নির্বাচন কমিশনে জমা দেওয়া হলফনামা অনুযায়ী, মহীউদ্দীন খান আলমগীরের মোট সম্পদের পরিমাণ ১৬ কোটি ৪১ লাখ টাকারও বেশি। গত এক বছরেই নিট সম্পদ বেড়েছে প্রায় এক কোটি ৮৭ লাখ টাকার। আর পাঁচ বছরে তাঁর ও স্ত্রীর সম্পদ বেড়েছে বহু গুণ। পাঁচ বছর আগে যেখানে তাঁর নিজের নগদ টাকা ছিল মাত্র পাঁচ লাখ, সেখানে এবার নিজের ও স্ত্রীর নগদ টাকাই আছে পাঁচ কোটিরও বেশি।
মহীউদ্দীন খান আলমগীরের বার্ষিক আয়ের মধ্যে কৃষি খাতে ৬০ হাজার টাকা, বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্ট, দোকান বা অন্যান্য ভাড়ায় নিজের আয় তিন লাখ ৮৫ হাজার ৫০০ টাকা, স্ত্রীর নামে আছে ১০ লাখ সাত হাজার ১০০ টাকা। নিজের ব্যবসায় আয় চার লাখ ৬৮ হাজার, বিভিন্ন শেয়ার, সঞ্চয়পত্র ও ব্যাংক সুদ এক লাখ ৩০ হাজার ২৯১ টাকা এবং স্থায়ী আমানত থেকে সুদ আয় হয় ২২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। নিজের চাকরি থেকে আয় আট লাখের কিছু বেশি।
অস্থাবর সম্পদের মধ্যে নিজের নগদ টাকা আছে তিন কোটি এক লাখ ৬০ হাজার ৬০৯ টাকা। স্ত্রীর নগদ টাকা দুই কোটি দুই লাখ ৩২ হাজার ৬৪৩ টাকা। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নিজের জমা ৫১ লাখ ১২ হাজার ২৫৯ টাকা। স্ত্রীর ৫১ লাখ ৪০ হাজার ৩৮ টাকা। ফার্মার ব্যাংকের লাইসেন্স পাওয়ায় এখানে নিজের নামে শেয়ার আছে আট কোটি ৫০ লাখ টাকার, অ্যাকটিভ ফাইন কেমিক্যাল লিমিটেডের শেয়ার আছে ২০ লাখ টাকার, বেক্সিমকো লিমিটেডের শেয়ার আছে ১০ লাখ টাকার, আইসিএবিতে ১০ লাখ টাকা, স্ত্রীকে ঋণ দিয়েছেন ৩৫ লাখ টাকা এবং শেয়ার ডিবেঞ্চারে বিনিয়োগ আছে আরও ২২ লাখ ছয় হাজার ৮৬ টাকা।
স্ত্রীর নামে আছে ফার্মার ব্যাংকে দেড় কোটি টাকার শেয়ার। নিজের নামে সঞ্চয়পত্র এক লাখ ৫০ হাজার টাকার। স্থায়ী আমানত এক কোটি তিন লাখ ২০ হাজার ৪০০ টাকা। স্ত্রীর নামে সঞ্চয়পত্র ১৫ লাখ ৭৫ হাজার টাকার।
নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা তাঁর হলফনামায় স্থাবর সম্পদসহ কয়েকটি খাতের লেখা অস্পষ্ট। তবে ওই হলফনামার সঙ্গে দেওয়া আয়কর বিবরণীতে তাঁর মোট সম্পদের পরিমাণ দেওয়া হয়েছে ১৬ কোটি ৪১ লাখ ৪৫ হাজার ৮১৪ টাকা। এর মধ্যে দায় (ঋণ) আট কোটি ৯৫ লাখ টাকা বাদ দিলে নিট সম্পদ থাকে সাত কোটি ৪৬ লাখ ৪৫ হাজার ৮১৪ টাকা। বিগত অর্থবছরের শেষের তারিখে তাঁর নিট সম্পদ ছিল পাঁচ কোটি ৫৯ লাখ ৭৪ হাজার টাকা।
দায় হিসাবে আট কোটি ৯৫ লাখ টাকা দেখালেও মহীউদ্দীন খান হলফনামায় বলেছেন, এটি তাঁর জামানতবিহীন ঋণ। তবে কার কাছ থেকে ঋণ নিয়েছেন, তা হলফনামায় উল্লেখ করেননি।
অথচ পাঁচ বছর আগে, ২০০৮ সালে মহীউদ্দীন খানের বার্ষিক আয় ছিল কৃষি খাতে ৩১ হাজার, বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্ট, দোকান বা অন্যান্য ভাড়া হিসেবে আয় দুই লাখ ৩৫ হাজার ৪৪০ টাকা এবং ব্যবসায় আয় ছিল দুই লাখ ৪০ হাজার টাকা। অস্থাবর সম্পদের মধ্যে তখন নিজের নামে নগদ টাকা ছিল পাঁচ লাখ। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে স্ত্রীর নামে জমা ছিল ১১ লাখ ৩৬ হাজার টাকা। দুই লাখ ছয় হাজার টাকার শেয়ার ছিল নিজের নামে এবং স্ত্রীর নামে সাত লাখ টাকার। বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্রে বা স্থায়ী আমানাতে স্ত্রীর নামে ছিল ৩১ লাখ ৭৫ হাজার টাকা। ছিল স্ত্রীর নামে একটি টয়োটা গাড়ি। স্বর্ণসহ অলংকারাদি নিজের দুই লাখ টাকা মূল্যের এবং স্ত্রীর ৩৫ হাজার টাকা মূল্যের।
স্থাবর সম্পদের মধ্যে ছিল নিজ নামে ১৩ দশমিক ১৮ একর কৃষি জমি, স্ত্রীর নামে ১ দশমিক ১৭ একর জমি। অকৃষি জমি নিজ নামে এক বিঘা। গ্রাম ও শহরে দালান ছিল ১৫ লাখ ৬৭ হাজার টাকা মূল্যের। স্ত্রীর নামে আছে তিনটি ফ্ল্যাট। গতবার তাঁর কোনো দায়দেনা ছিল না।
জানতে চাইলে মহীউদ্দীন খান আলমগীর বলেন, সম্পদের হিসাব ঋণ বাদ দিয়ে ধরতে হবে। আর সম্পদের বিপরীতে তো আয়করও দেওয়া হয়েছে এবং তা গ্রহণও করা হয়েছে।
সামগ্রিকভাবে মন্ত্রী-সাংসদদের সম্পদ বৃদ্ধি নিয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, এই তথ্যগুলো উদ্বেগজনক। এখন তদন্ত করে দেখা উচিত, আসলে এসব সম্পদ কীভাবে হলো। এসব তথ্য প্রকাশ করার জন্য গণমাধ্যমকে ধন্যবাদ জানান তিনি।

শুধু নিজে নন, স্ত্রীকেও ধনী করেছেন রণজিত

 
.১২ বিঘা কৃষিজমি, ঢাকার পূর্বাচলে রাজউকের ১০ কাঠার প্লট, বাঘারপাড়ার খাজুরা বাজারে দুই হাজার ২০০ বর্গফুটের দোতলা ভবন, নিজের নামে নগদ তিন লাখ ও ব্যাংকে এক লাখ ৪২ হাজার টাকা, সাত লাখ টাকা দামের দুটি গাড়ি, দেড় লাখ টাকার সোনা।
স্ত্রীর নামে দুটি ফ্ল্যাট ও ৪৪ লাখ টাকার দালান; ব্যাংকে এক কোটি ১৩ লাখ টাকা ও নগদ তিন লাখ টাকা, ডিপিএস চার লাখ ৮০ হাজার, ১৬ লাখ ১০ হাজার টাকা দামের একটি গাড়ি ও এক লাখ ৮০ হাজার টাকার সোনা।
এত সব সম্পদ আওয়ামী লীগের সাংসদ রণজিত কুমার রায়ের। যশোর-৪ (বাঘারপাড়া-অভয়নগর ও সদর উপজেলার বসুন্দিয়া ইউনিয়ন) আসন থেকে এবারও তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী। রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে দাখিল করা তাঁর হলফনামা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, তাঁর স্ত্রী নিয়তি রায় গৃহিণী হয়েও পাঁচ বছরে সাংসদ স্বামীর চেয়ে অনেক বেশি অর্থ-সম্পত্তির মালিক হয়েছেন।
২০০৮ সালে দেওয়া হলফনামায় স্থাবর সম্পত্তির মধ্যে রণজিতের নিজের নামে ছিল এক লাখ টাকার বাঘারপাড়ায় চার বিঘা পৈতৃক জমি এবং ৫০ হাজার টাকা দামের খাজুরা বাজারে আধা পাকা টিনের বাড়ি। স্ত্রীর নামে কিছুই ছিল না।
রণজিত কুমার রায়ের আড়তদারি ব্যবসা এবং কৃষিজমি থেকে বছরে আয় ছিল এক লাখ ৬৭ হাজার টাকা। পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকার পর তাঁর আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। ক্ষমতার পাঁচ বছরে এইচএসসি পাস এই সাংসদ কীভাবে সম্পদের পাহাড় গড়লেন, সেটা নিয়ে এলাকায় নানা কৌতূহল। এমনকি নিজের দলেও আছে নানা সমালোচনা।
আওয়ামী লীগের বাঘারপাড়া উপজেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক জুলফিকার আলী এ বিষয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘এমপি হওয়ার আগে যে রণজিতের একটা সাইকেল কেনার আর্থিক সংগতি ছিল না, সেই রণজিত এখন রাজার হালে তিনটা গাড়িতে চড়েন। পাঁচ বছরে তিন শ থেকে পাঁচ শ কোটি টাকা লুটপাট করে তিনি বিশাল বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন।’
সাংসদ রণজিত অবশ্য নিজেকে ‘খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন’ মানুষ হিসেবে দেখতে পান। তাঁর ভাষায়, ‘যশোরের ছয় এমপির মধ্যে আমি খুবই ভালো লোক। এটা আমি গর্ব করে বলছি। এখন আমাকে কালার করার জন্য অনেকে বলবে যে এমপি শিক্ষক নিয়োগের বাণিজ্য করে সম্পদ গড়েছেন।’ তাঁর যুক্তি, রাজনীতি করতে গেলে এমন অনেক অভিযোগ উঠবে।
সর্বশেষ হলফনামায় আয়ের উৎস হিসেবে দেখানো হয়েছে, বেতনের তিন লাখ ৩০ হাজার, বাড়ি, দোকান ও অন্যান্য ঘর ভাড়া দুই লাখ ১০ হাজার, মাছ চাষের ব্যবসায় তিন লাখ ৯২ হাজার, কৃষি খাতের ৬৩ হাজার ও অন্যান্য ভাতা থেকে চার লাখ টাকা। সব মিলিয়ে বছরে মোট ১৩ লাখ ৯৫ হাজার টাকা তাঁর আয়।
হলফনামার বাইরে আরও সম্পদ: সরেজমিনে জানা গেছে, যশোর শহরের পিটিআই সড়কে তিনি কিনেছেন চারতলা বাড়ি। খাজুরা বাজারের টিনের আধা পাকা বাড়িটি এখন তিনতলা ভবন। এর নিচতলায় মার্কেট ও দোতলায় সোনালী ব্যাংকের কাছে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। বাঘারপাড়া বাজারে রয়েছে আরেকটি ভবন। বড় ছেলেকে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে ঢাকায় ব্যবসা বানিয়ে দিয়েছেন।
এসব নিয়ে কথা হয় সাংসদ রণজিতের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘যশোর শহরে যে বাড়ি করিছি, তা ইনকাম ট্যাক্সের খাতায় ঢুকানো আছে। খাজুরা বাজারের বাড়িটা আমার পৈতৃক বাড়ি। সেটিও ইনকাম ট্যাক্সের ফাইলে নথিভুক্ত করা আছে। লোন নিয়ে ছেলেকে একটা গাড়ি কিনে দিছি, তাতে অসুবিধা কী? লোন নিয়ে গাড়ি-বাড়ি কিনতি পারব না, এমনকি কোনো নিষেধ আছে?’
এলাকার বিভিন্ন সূত্র ও দলীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁর এত অবৈধ সম্পদ এসেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ-বাণিজ্য থেকে। অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়ার কারণে সম্প্রতি বাঘারপাড়ার বাঁকড়ি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ-প্রক্রিয়া স্থগিত রাখার নির্দেশ দেন আদালত।
‘বাঁকড়ি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে চার পদে নিয়োগ, সাংসদের পক্ষে ২০ লাখ টাকা আদায়ের অভিযোগ’ শিরোনামে গত ২ নভেম্বর প্রথম আলোর শেষের পাতায় একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ছাপা হয়।
ওই বিদ্যালয়ের নিয়োগ-সংক্রান্ত অনিয়মের অভিযোগ তুলে গত ১৮ সেপ্টেম্বর সহকারী প্রধান শিক্ষক পদপ্রার্থী কুমারেশ চন্দ্র বিশ্বাস ও হিমা বিশ্বাস যশোরের সহকারী জজ আদালতে মামলা করেন। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে নিয়োগের ওপর অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারি করেন।
বাঘারপাড়া ও যশোর সদর উপজেলার মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাদের কাছ থেকে জানা গেছে, এ বছরে সদর উপজেলার পাঁচ ইউনিয়নে মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও মাদ্রাসায় ২৫ জন এবং বাঘারপাড়া উপজেলায় ২০১২ সালের আগস্ট থেকে চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত ৩৮ জন শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
শিক্ষা কর্মকর্তারা জানান, শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগের কোনো হিসাব রাখা হয় না। ফলে গত পাঁচ বছরে কতজন শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ করা হয়েছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। চাকরি দেওয়ার নামে প্রত্যেকের কাছ থেকে তিন থেকে ছয় লাখ টাকা করে ঘুষ নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।
যশোরের একজন শিক্ষা কর্মকর্তা বলেন, নিয়োগের পরীক্ষা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানে হওয়া উচিত। অন্যান্য উপজেলায় সেটা হলেও বাঘারপাড়ার চিত্র ছিল ভিন্ন। সার্কিট হাউসে সব শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে। সাংসদের নির্দেশে সেখানেই বোর্ড বসিয়ে নিয়োগ চূড়ান্ত করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রণজিত রায় বলেন, ‘শিক্ষক নিয়োগ হলি দেশের এমপিরা কত কোটি টাকা লুট করে নেচ্ছে, তার কোনো ইয়ে আছে? তবে আমার সাথে কারও কোনো টাকাপয়সার লেনদেন নেই। আমার নাম করে অনেকে লোকজনের কাছ থেকে টাকাপয়সা নেছে বলে আমি শুনিছি। আমাকে না জানিয়ে কেউ টাকাপয়সা লেনদেন করলি আমার কী করার আছে?’
তিনি একাই ১৬ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি: রণজিত কুমার রায় একাই ১৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটির সভাপতি হয়েছেন। যদিও চারটির বেশি প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হওয়ার নিয়ম নেই। এ প্রসঙ্গে সাংসদ বলেন, ‘পদাধিকারবলে এমপি চারটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সভাপতি হতে পারেন। এ বাদে আরও কিছু প্রতিষ্ঠানের সভাপতি আমি হয়েছি, এটা ঠিক। কিন্তু সেগুলো আমার ইচ্ছায় নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দলাদলির কারণে কমিটির লোকজন হুট করে সভাপতি পদে আমার নাম বলে বসেন। তখন দলাদলি ঠেকাতে সভাপতি হতে হয়েছে। তা ছাড়া সামাজিক মর্যাদা থাকলে আমি ১০ জায়গার সভাপতি তো হতেই পারি।’

AD BANNAR