Showing posts with label Article. Show all posts
Showing posts with label Article. Show all posts

Friday, 8 November 2013

কুকুরের এমবিএ ডিগ্রি ও অন্যান্য

 
কার্টুন: তুলিএকটা কুকুর লাভ করেছে এমবিএ ডিগ্রি। আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন থেকে। বিবিসি নিউজনাইট এই তথ্য উন্মোচন করেছে। আবার একটা কুকুরকেও যে একটা বিশ্ববিদ্যালয় এমবিএ ডিগ্রি দিতে পারে, সেই নাটকটা সাজিয়েছেও তারাই। তারা এইউওএল নামের ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএর জন্য আবেদন করেছে কুকুরের নামে। বলেছে, এমবিএ ডিগ্রি চাই। তারা একটা জীবনবৃত্তান্ত বানিয়েছে, সম্পূর্ণ মিথ্যা তথ্য দিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম হলো, পুরোনো ডিগ্রির কপি, শিক্ষার্থীর ফটো জমা দিতে হবে। যেহেতু আবেদনকারী একটা কুকুর, কাজেই তারা তা জমা দিতে পারেনি।
‘তাই বলে কি আমি ডিগ্রি পাব না?’ ফোনে জানতে চাওয়া হয়েছে।
‘কেন নয়? আপনাকে ৪৫০০ পাউন্ড জমা দিতে হবে।’
ওই পরিমাণ পাউন্ড দেওয়া হয়ে গেলে কুকুরের নামে চলে এসেছে এমবিএ ডিগ্রি। কুকুরটির নাম পিট। সে থাকে ব্যাট্রেরেসা কুকুর-সদনে।
সম্প্রতি এই খবর প্রকাশিত হয়েছে, হইচই পড়ে গেছে বিলেতে। সবচেয়ে লজ্জায় আছেন তাঁরা, যাঁরা ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি তাঁদের নামের শেষে ব্যবহার করে মুখ-উজ্জ্বল করে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন।
ডিগ্রি নিয়ে নানা ধরনের রসিকতা চালু আছে। যাঁদের ডিগ্রি অকৃত্রিম; পরিশ্রম, মেধা আর সময় বিনিয়োগের মাধ্যমে পাওয়া, তাঁরা আশা করি ক্ষমার চোখেই দেখেন এই সব রসিকতাকে।
ছোটবেলায় একটা গল্প শুনেছিলাম। পাঠশালার সামনে দিয়ে যাচ্ছে এক ধোপা। সে শুনতে পেল, ক্লাসরুমে একজন শিক্ষক তার কোনো ছাত্রের উদ্দেশে বলছে, ‘কত গাধা পিটিয়ে মানুষ করলাম, আর তোকে মানুষ করতে পারব না?’ শুনে ধোপা তার গাধাটিকে নিয়ে এসে হাজির: ‘মাস্টার সাব, আমার গাধাটাকেও পিটিয়ে মানুষ করে দিন না?’
ভুয়া পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে একটা নির্মম কৌতুক প্রচলিত আছে। এক লোক যাচ্ছে ঘোড়ার পিঠে চড়ে। পথে শুনতে পেল, এখানে একটা বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যেখানে টাকার বিনিময়ে ডক্টরেট ডিগ্রি দেওয়া হয়। পথিকের সঙ্গে টাকা ছিল। কাজেই সে গেল বিশ্ববিদ্যালয়ে। বলল, ‘ডিগ্রি দিন। কত টাকা লাগবে?’
টাকাপয়সার লেনদেন হয়ে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়টি তাকে পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করল। ডক্টরেট ডিগ্রি সঙ্গে নিয়ে লোকটা ফিরছে ঘোড়ার পিঠে চড়ে। তার মনে হলো, টাকা দিলেই যদি ডিগ্রি পাওয়া যায়, তাহলে আমার ঘোড়াটার জন্যও তো একটা ডিগ্রি কেনা যায়। সে আবার গেল বিশ্ববিদ্যালয়ে, বলল, ‘এই নিন টাকা, আমার ঘোড়াটাকেও একটা পিএইচডি ডিগ্রি দিন।’ তখন কর্তৃপক্ষ জবাব দিল, ‘স্যরি, আমরা শুধু গাধাদেরই ডিগ্রি দিই, ঘোড়াদের দিই না।’
একবার একটা কুকুরের প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়েছিল আদালতে। ঘটনা তানজানিয়ার। কুকুরটিকে দেওয়া হয় প্রাণদণ্ড, আর তার মালিককে কারাদণ্ড। কারণ, কুকুরের মালিক কুকুরের নাম রেখেছিলেন ‘ইমিগ্রেশন’। তানজানিয়ার বহিরাগত পুনর্বাসন বা ইমিগ্রেশন বিভাগ তাতে চটে যায়। তারা মামলা করে দিলে এই নাম ধারণ করার অপরাধে কুকুরটির মৃত্যুদণ্ড আর তার মালিকের কারাদণ্ডের রায় দেন মাননীয় আদালত।
আব্রাহাম লিংকন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। চারদিক থেকে লোকজন আসতে লাগল তাঁর কাছে। তারা বলতে লাগল, ‘আমরা বিপ্লবের জন্য অনেক কিছু করেছি। অনেক ত্যাগ করেছি। আমাদের মূল্যায়ন করুন। আমাদেরকে পদ দিন।’
লিংকন তখন একটা গল্প বলেছিলেন:
এক রাজা বেরিয়েছেন শিকারে। তিনি তাঁর মন্ত্রীদের জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আজকে আবহাওয়ার পূর্বাভাস কী? ঝড়বৃষ্টি কি হবে?’ মন্ত্রীরা বলল, ‘জি না হুজুর, আজ আবহাওয়া চমৎকার। ঝড়বৃষ্টি হবে না।’
রাজা চলেছেন। পথে দেখা একজন ধোপার সঙ্গে। রাজাকে সে বলল, ‘রাজামশাই, আপনি যে সামনে এগোচ্ছেন, সামনে তো ঝড়বৃষ্টি হবে।’
রাজা তার কথা শুনলেন না। এগোতে লাগলেন। খানিক পরে সত্যি সত্যি ঝড়বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল।
রাজা ফিরে এলেন। বললেন, ‘আবহাওয়ামন্ত্রীকে বরখাস্ত করো। ধরে নিয়ে এসো ওই ধোপাকে। ওকেই মন্ত্রী করব।’
রাজা ধোপাকে মন্ত্রী করলেন।
রাজা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা, তুমি কেমন করে বললে, সামনে ঝড়বৃষ্টি হবে?’
ধোপা বলল, ‘যখন ঝড়বৃষ্টি আসন্ন, তখন আমার গাধার কান নড়ে। তখন আমার গাধার কান নড়ছিল। সেটা দেখে আমি বুঝলাম, একটু পরেই ঝড়বৃষ্টি শুরু হবে।’
রাজা বললেন, ‘তাহলে আর তোমাকে মন্ত্রী করব কেন? তুমি বরখাস্ত। যাও, নিয়ে এসো সেই গাধাকে। তাকেই আমি মন্ত্রী বানাব।’
রাজা গাধাকেই মন্ত্রী বানালেন।
শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক তখন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। একজন চাষি নিজের ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। মুখ্যমন্ত্রীকে বললেন, ‘হুজুর, ছেলেকে চাকরি দিন।’
‘লেখাপড়া কত দূর?’
‘ম্যাট্রিক ফেল।’
‘তাহলে চাষবাসের কাজে ওকে লাগাও না কেন?’
‘হুজুর, লেখাপড়া শিখেছে, ওকে কী করে হালচাষ করতে লাগাই?’
‘তাহলে ওকে একটা দোকান করে দাও।’
‘দোকানের কাজে ওর মন নাই।’
‘তাহলে তো তোমার ছেলের আর কোনো উপায় নাই। ওকে মন্ত্রী করেই নিতে হয়।’
শেরেবাংলাকে নিয়ে আরেকটা গল্প। তখনো তিনি অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী। তাঁর কাছে একটা আবেদন এসেছে। ইউনিয়ন পরিষদের মালটানা গাড়ির বলদের জন্য খড় কেনা বাবদ ৪৫ হাজার টাকা বরাদ্দের আবেদন।
শেরেবাংলা খড়ের দাম জানতেন। তিনি ওই দরখাস্তে লিখলেন, ‘এত খড় কি কেবল বলদে খাবে?’
আজকের এই লেখায় কোনো সিরিয়াস বিষয়ে গেলাম না; কারণ, দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যা চলছে, তা নিয়ে রসিকতা ছাড়া আর কীই-বা করার আছে?
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

ভরসা রাখুন বাংলাদেশের জনগণে

নির্বাচনী কূটনীতি-২

মিজানুর রহমান খান 
শেখ হাসিনা, মনমোহন সিং, খালেদা জিয়াভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রেস ব্রিফিংয়ে গত ৩১ অক্টোবর বাংলাদেশসংক্রান্ত দুটি প্রশ্ন উঠেছিল। গতকালের লেখায় প্রথমটি আলোচনা করেছি। দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিল: আপনি কি দয়া করে বলতে পারেন যে বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক অচলাবস্থায় ভারতের স্বার্থ কী? এর উত্তর সংগত কারণেই কেতাবি: ‘আমি এখানে কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি সম্পর্কে মন্তব্য করতে আসিনি। সে কারণে আপনার প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’ তবে বাস্তবে প্রতিবেশীদের ‘অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে’ ভারত প্রায় সর্বদা সক্রিয় রয়েছে।
ইন্দ্রানী বাগচী হয়তো বাংলাদেশের নির্বাচনের পক্ষ-বিপক্ষ নির্ধারণে ভারতীয় একটি প্রভাবশালী সরকারি মহলের ইঙ্গিতকেই তাঁর লেখায় ‘ভারতের’ হিসেবে নির্ধারণ করেছেন। তাদের একটি বিষয় বুঝতে হবে। অন্তত শতকরা ৩৩ ভাগ ভোট পায় বিএনপি। দিল্লির কাছে তারা ‘বিরক্তিকর’। বাংলাদেশের ওই ৩৩ ভাগের কাছে তারা সুখকর। একে অগ্রাহ্য করে ভারত তার নিজের স্বার্থ টেকসই ভাবতে পারে না। সেটা তার অজানা নয়।
টাইমস অব ইন্ডিয়ায় ইন্দ্রানী বাগচী বিএনপি-জামায়াতকে ইঙ্গিত করে লিখেছেন, ‘ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা পাকিস্তানভিত্তিক লস্কর-ই-তাইয়েবা এবং আল-কায়েদার প্রভাব চিহ্নিত করেছে।’ মনমোহন-ওবামা ইশতেহারে এদের নির্মূলে অভিন্ন লড়াইয়ের দ্ব্যর্থহীন অঙ্গীকার রয়েছে। তাই ভারতীয় গোয়েন্দারা এমন তথ্য মার্কিনদের না জানিয়ে পারে না। এতে ড্যান মজীনা শুধু নন, এই অঞ্চলের সব মার্কিন এবং দক্ষিণ এশীয় রাষ্ট্রদূতেরা কান খাড়া না করে পারবেন না। সেটা সত্যি ঘটলে তা ঠেকাতে গণতন্ত্র মেনে কৌশল নিতে হবে। আফগানিস্তানের ‘ক্রান্তিকাল’ সামলাতে শশব্যস্ত বহিঃশক্তিগুলোর বাংলাদেশ নীতি কী? তারা আরেকটি ক্রান্তিকাল এড়াচ্ছে, নাকি ডেকে আনার বা ক্রান্তিকাল এলে নীরব দর্শক থাকার প্রস্তুতি নিচ্ছে?
২০০৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি একটি ওয়েবচ্যাটে অংশ নিয়েছিলাম। বাংলাদেশের দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের মার্কিনরা আশ্রয় দেবে কি না—এর উত্তরে মার্কিন মুখপাত্র ডেভিড লুনা বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও জি-৮ ক্লেপটোক্র্যাটদের (যারা সরকারি পদ ব্যবহার করে অর্থ ও সম্পদ গড়ে) বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। প্রেসিডেন্টের ৭৭৫০ নম্বর ফরমানে যুক্তরাষ্ট্র তাদের প্রবেশ স্থগিত করতে পারে। ২০০৮ সালে মার্কিন দূতাবাস ‘ক্লেপটোক্র্যাট সরকার ও সহিংস রাজনীতির প্রতীক’ হিসেবে তারেকের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ নিষিদ্ধ করতে সুপারিশ করল। জি-৮ ভুক্ত ব্রিটেনই হলো তারেকের নিরাপদ আশ্রয়। গত ২৩ সেপ্টেম্বরে সেখানেই তারেকের সঙ্গে ৪০ মিনিট বৈঠক করেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন পলিটিক্যাল কাউন্সেলর পুশপিন্দার ধিলন। মার্কিন রাষ্ট্রদূত ২০০৮ সালে তারেককে নির্দিষ্টভাবে মার্কিন ‘জাতীয় স্বার্থের’ জন্য বিপজ্জনক মনে করেছিলেন। তারেক-ধিলনের লন্ডন বৈঠকও হয়তো বর্তমানের মার্কিন ‘জাতীয় স্বার্থের’ সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ নয়। কূটনৈতিক সূত্রের খবর, তারেকের সঙ্গে আলোচনায় ধিলন আস্থা পাননি। সীমান্তের বাইরে তাদের কারও সঙ্গেই কারও শত্রুমিত্রতা নয়, প্রত্যেকের স্বার্থটাই স্থায়ী। বাংলাদেশের কোনো কোনো দল তা বুঝতেই চায় না। মজীনার চীন সফরের খবরটি ঠিক ছিল না। ঢাকা সফররত রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান স্টিভ শ্যাবট স্পষ্টভাষী না হয়ে যান না। ২০০৬ সালের পর সাতটা বছর পেরিয়ে গেলেও তিনি একই আবহাওয়ায় ঢাকায় এসেছেন। বাংলাদেশের রাজনীতির পূর্বাভাস দিতে বললে তিনি বলেন, ‘দুই নেত্রী কারাগারে যেতে চাইবেন না।’
অধুনা প্রতিটি মুসলিম রাষ্ট্রের সহিংস হওয়া মানেই হাজার হাজার লাশ। অনলাইনে ইরাক বডিকাউন্টের মতো বাংলাদেশ বডিকাউন্ট আমরা দেখতে চাই না। ২২ বছরে আড়াই হাজার লাশের খবর জেনে অনেক মুসলিম দেশ আমাদের এখনো ঈর্ষা করতে পারে।
খালেদা জিয়া তাঁর নির্বাচনী ফর্মুলা ভাষণে নির্দিষ্টভাবে সন্ত্রাসবাদ প্রশ্নে ভারত ও অন্যদের আশ্বস্ত করতে যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন। এতে মার্কিন ও তার মিত্ররা যত সহজে আশ্বস্ত হতে পারে, সেটা ভারত হতে পারে না। ভারতের আস্থা পেতে খালেদা জিয়াকে সম্ভবত আরও প্রমাণ দিতে হবে। ১৯৯১ সালে ক্ষমতায় আসার পরে ভারত তার সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মুচকুন্দ দুবেকে বিশেষ দূত করে পাঠিয়েছিল। এরপর তিনবিঘা চুক্তি হলো। সাইফুর রহমান আওয়ামী লীগের নিন্দা কুড়িয়েও ভারতের জন্য বাংলাদেশকে উন্মুক্ত করলেন। সেই দুয়ার কিন্তু আর বন্ধ হয়নি। তবে এর ধারাবাহিকতা থাকেনি। ২০০১ সালের পরে আবার সম্পর্ক গড়ার চেষ্টা চলে। কিন্তু তা দ্রুত ভেঙে পড়ে। ডিজিএফআই এবং এনএসআইতে কট্টর ভারতবিরোধীদের নিয়োগ দিল্লিকে বিচলিত করে। উলফাকে আশ্রয়-প্রশ্রয় ও দশ ট্রাক অস্ত্রের ঘটনায় বিএনপির সঙ্গে দূরত্ব আরও বাড়ে।
গত ১ নভেম্বর ঢাকেশ্বরী মন্দিরে নির্বাচনের দিকে ইঙ্গিত করেন ভারতের ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার সন্দ্বীপ চক্রবর্তী। তাঁর দ্বিধান্বিত উক্তি: ‘রাজনৈতিক ফলাফল যা-ই হোক, দুই দেশের আত্মীয়তা আরও বাড়বে।’ আশির দশকে ঢাকায় ভারতের হাইকমিশনার ছিলেন মুচকুন্দ দুবে। সেই সময় তিনি বাংলাদেশি পণ্যে শূন্য শুল্ক দিতে ভারত সরকারের কাছে চিঠি লিখেছিলেন। নব্বইয়ের দশকের শেষে আমাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি আফসোস করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমার যুক্তি ছিল, এটা দিলে বাংলাদেশি পণ্যে ভারতের বাজার সয়লাব হবে না।’ দুঁদে দুবে দূরদর্শী ছিলেন। বহু বছরের দেনদরবারের পর ভারত ২০১১ সালে এসে প্রায় শতভাগ বাংলাদেশি পণ্যকে শুল্কমুক্ত বাজারসুবিধা দিয়েছে। দুবের কথা ফলতে প্রায় দুই দশকের বেশি সময় লেগেছে। কারণ, দেওয়া-নেওয়ার কূটনীতি নানা মাত্রায় ওঠানামা করেছে। এখন ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি আগের তুলনায় কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রতিকূলে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ঘাটতি এখন ৪১৭ কোটি ডলার।
রাজনৈতিক সহিংসতা ও ধর্মের নামে সহিংসতার মধ্যে তফাত গৌণ। রাষ্ট্রের সন্ত্রাস, নাকি বেসরকারি বাহিনীর সন্ত্রাস, কোনটা ভয়ংকর—নাগরিকের কাছে এই তর্ক বৃথা। সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন না হলে রাজনীতির র‌্যাডিকালাইজেশন বা সহিংসতার বিস্তার ঘটতে পারে। সুতরাং, বাংলাদেশ এবং দক্ষিণ এশিয়ার স্থিতিশীলতার বড় হুমকি একতরফা নির্বাচন। একটি অপেক্ষাকৃত অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন এবং তার মধ্য দিয়ে অধিকতর কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে ওঠা একটি শাসনব্যবস্থা আঞ্চলিক শান্তির জন্য হুমকি। কারণ, তা আপনাআপনি সহিংসতা ও অস্থিতিশীলতার জন্ম দিতে পারে। ভারত যুক্তি দিতে পারে যে, তারা বারংবার ক্ষমতাসীন দলের উচ্চপর্যায়ে বিরোধী দলকে সঙ্গে নিতে, মার্কিনদের সঙ্গে দূরত্ব কমাতে ও ড. ইউনূসকে ক্ষুব্ধ না করার নীতি মানিয়ে চলারই তাগিদ দিয়েছেন। কিন্তু তাতে আমল না দিলে তার কী করার আছে? এই মুহূর্তে বিএনপি না এলে বা তাকে না আনতে পারলে ‘সংবিধান অনুযায়ী’ নির্বাচনকে সমর্থন না দেওয়ার বিকল্প কী?
বিএনপি-জামায়াত জোটের সম্ভাব্য সরকার গঠনজনিত নিরাপত্তাহীনতা, নাকি প্রহসনমূলক নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত একটি ‘অবৈধ’ সরকারব্যবস্থার নিরাপত্তাহীনতা আখেরে বেশি ক্ষতিকর, সেই প্রশ্নটি উড়িয়ে দেওয়ার নয়। যদিও দুটোই বিপজ্জনক। আমরা কৃত্রিম অস্ত্রোপচার নয়, গণতান্ত্রিক নির্বাচনের পক্ষে। জঙ্গিবাদ ও স্বৈরতন্ত্র দুটোই সন্ত্রাসবাদ। দুই হুমকি মোকাবিলায় গণতান্ত্রিক স্বচ্ছতা লাগবেই। রাষ্ট্রধর্ম দিয়ে সংখ্যালঘুর স্নায়ুপীড়নকারী জেনারেল এরশাদের বন্দুকের নলে প্রজাপতি দেখেছিল আনন্দবাজার গ্রুপ। এরশাদ আজও দিল্লির বিরক্তিকর বন্ধু নন। পয়গাম পাঠিয়ে দিল্লিতে তাঁর উষ্ণ আতিথেয়তা তারই প্রমাণ।
সন্দ্বীপ চক্রবর্তী বাংলা-ভারত সম্পর্ক বলতে গিয়ে দুই দেশের জনগণ ‘বন্ধু নয় আত্মীয়’ কথাটা বলেন। আমরা তা খুবই মানি। তিনি প্রথমে গত ‘পাঁচ-ছয় বছরে’ বলতে গিয়েই বিপদ টের পান। তাই দ্রুত ২০০০ সাল থেকে ধরে বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রতি কর্তব্য পালনে ভারত কোনো কোনো সময় বিফল হয়েছে, তা আমি স্বীকার করব।’ তিনি আমাদের তাঁর কথায় সম্পর্কের ব্যালান্স শিটের দিকে তাকানোর পরামর্শ দেন। আর বলেন, এতটা বিশাল অর্জন আগে কখনো দেখা যায়নি। কী দিয়ে মাপব বলুন? ‘বাংলাদেশের কোনো দলের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক আছে মানুষের সঙ্গে।’ বহুল উচ্চারিত এই উক্তিটিও যথারীতি তাঁকে করতে হয়। এটা ভারতীয় কূটনীতির সীমাবদ্ধতারই স্বীকৃতি। প্রণব মুখার্জিকে সাক্ষাৎ না দিয়ে একটি পাকিস্তানবৎ আশ্চর্য আচরণ করেছিলেন বিএনপির নেত্রী। দিল্লিতে তাঁকে বিশেষভাবে সম্মানিত করার প্রতিদান তিনি দিতে পারেননি। এটুকু বাদে এও সত্য যে, ভারতীয় প্রতিনিধিগণ বিএনপির নেত্রীর সঙ্গে নিয়মিত সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন।
বাংলাদেশের সঙ্গে গত পাঁচ বছরে সাউথ ব্লকের বিশ্বাসভঙ্গের ঘটনা ঘটেছে কি না? সোনিয়া গান্ধীর ছায়ায় মনমোহন সিংয়ের মতো নিষ্কলুষ ব্যক্তিত্ব কেন ঢাকা-দিল্লির জং ধরা রেকর্ড ভাঙতে পারলেন না? পাঁচ বছরের একটি মেয়াদে কেন অন্তত দুটি ফিরতি শীর্ষ সফরও করা গেল না? একজন মনমোহন যা পারেননি, তা একজন সম্ভাব্য নরেন্দ্র মোদি কেন পারবেন? ভারতের সম্ভাব্য নির্বাচনী ফলাফল ও তার প্রভাব ক্ষমতাসীনেরা উপেক্ষা করতে পারে না।
সি. রাজা মোহন ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস পত্রিকার প্রদায়ক সম্পাদক। তিনি বাংলা-ভারত সম্পর্কবিষয়ক একজন স্বীকৃত বিশেষজ্ঞ। গত ১৯ আগস্ট তিনি ওই পত্রিকায় যে নিবন্ধটি লিখেছেন, সেটি সন্দ্বীপ চক্রবর্তীর উল্লিখিত ‘ব্যালান্স শিট’ বুঝতে সহায়ক। গত প্রায় পাঁচ বছরে বাণিজ্যে-বিদ্যুতে অনেক উন্নতি ঘটেছে। রাজা মোহন তা জেনেও লিখেছেন, ‘যখন দিল্লির সঙ্গে তার সব প্রতিবেশীর সম্পর্কে ঝোড়ো হাওয়ার অধ্যায়টা শুরু হলো, হাসিনাই তখন একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন উপায়ে ভারতের প্রতি সহযোগিতার হাত প্রশস্ত করলেন।’ ভারত বিরোধিতার অবতার থেকেও বিএনপি কিন্তু ভারত বিরোধিতার জিগির তোলেনি। জমিজিরাত নষ্ট করে বাংলাদেশ কেবল ভারতীয় ভারী মালামাল ত্রিপুরায় পৌঁছাতে আশুগঞ্জ নদীবন্দর থেকে আখাউড়া স্থলবন্দর পর্যন্ত ক্রান্তিকালীন বিশেষ মৈত্রী সড়ক সৃষ্টি করেছিল। এ নিয়ে অযথা মানুষ খেপানোর রাজনীতি করেনি বিরোধী দল।
আমরা বিশ্বাস করতে চাই, শেখ হাসিনা ভোটের রাজনীতির জন্য নয়, জাতীয় স্বার্থে ভারতের প্রতি উদারতা দেখিয়েছিলেন। কিন্তু প্রতিদান মেলেনি। রামমোহন তাই যথার্থই মন্তব্য করেন: ‘তিস্তা ও সীমান্ত চুক্তি করতে দিল্লি যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে কথোপকথক হিসেবে দিল্লির বিশ্বাসযোগ্যতায় তা ভয়ংকর আঘাত হানবে।’ ভারতে বাংলাদেশের বন্ধুগণ অন্তত উড়িয়ে দেবেন না যে, এটা ইতিমধ্যে উপকূলে আঘাত হেনেছে।
বান কি মুন নাকি প্রধানমন্ত্রীকে শুধিয়েছেন, লেভেল ঠিক করতে যথেষ্ট কিছু করা হয়েছে কি? শেখ হাসিনা তাঁকে শোনান সংবিধানের কথা। বান কি মুন ‘সবার অংশগ্রহণের নির্বাচনের ওপর জোর দেন। হাসিনা পর্যবেক্ষক পাঠাতে অনুরোধ করেছেন। তবে তিনি তা রক্ষা করবেন কি না, তা পরিষ্কার নয়।
ঢাকার কূটনীতিতে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ এবং ‘ইনক্লুসিভ’ কথাটি বেশ চালু হয়েছে। কিন্তু ইনক্লুসিভ অর্থাৎ বিএনপিকে নিয়ে নির্বাচনে ভারতের সংকেত আমাদের বুঝতে বেশ অসুবিধা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের কাছে কি তা স্পষ্ট? কোথাও কি ভুল হচ্ছে? আরটিভি থেকে নেওয়া ভিডিও ফুটেজ দেখলাম। অনেক সূচকে ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের এগিয়ে থাকার কথা বলছিলেন তিনি। বাংলা ভাষায় দেওয়া তাঁর বর্ণনায় ‘আত্মীয়ের’ অত্যুজ্জ্বল আভা। বলছিলেন, আত্মীয়ের প্রতি বাধ্যবাধকতা ও দায়িত্বশীলতা থাকে।
বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, দুই দলই মনে করে, জিততে হলে ভারত ও মার্কিন আশীর্বাদ লাগবেই। শেখ হাসিনা হয়তো এখন মনে করছেন, মার্কিনকে তার লাগবে না। খালেদা জিয়া নাকি ভাবেন, ২০০১ সালে ভারত-মার্কিনের কারণে তাঁর দল বড় জয়ের মুখ দেখেছিল। এবারও মার্কিন দোয়া আছে। তবে সহিংসতা ও অশান্তি হলে তার দায়দায়িত্ব দুই প্রধান দলকেই নিতে হবে।
আমরা বলি, দিল্লি ও ওয়াশিংটনকে না বলুন। কেবল ভরসা রাখুন বাংলাদেশের জনগণে। শেষ
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

Sunday, 20 October 2013

কে হবেন ‘সর্বদলীয় সরকারের’ প্রধান?

কে হবেন ‘সর্বদলীয় সরকারের’ প্রধান?

আসিফ নজরুল | আপডেট: ০০:৪১, অক্টোবর ২০, ২০১৩ | প্রিন্ট সংস্করণ @ Prothom-alo
কার্টুন:তলিপ্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৮ অক্টোবরের ভাষণ শুনে আমাদের শ্রদ্ধেয় কিছু ব্যক্তি খুবই আশাবাদী হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য ব্যারিস্টার রফিক-উল হক। গতকাল প্রথম আলোকে তিনি বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বদলীয় সরকার গঠনের যে প্রস্তাব দিয়েছেন, এর চেয়ে উত্তম আর কিছু হতে পারে না। বিরোধী দলের উচিত হবে প্রধানমন্ত্রীর এই প্রস্তাব গ্রহণ করা।’
দেশে যা অবস্থা, তাতে রফিক-উল হকের মতো সবারই আশাবাদী হতে ইচ্ছা করে। কিন্তু তাঁর মতো আশাবাদী হওয়ার সদ্গুণ সবার নিশ্চয়ই নেই। আমি বরং সবিনয়ে বলতে চাই, সবাই আশাবাদী হয়ে উঠলে এবং তা বাস্তবোচিত না হলে তাতে মানুষ বিভ্রান্ত হতে পারে, ক্ষমতাসীনেরা ভুল বার্তা পেতে পারেন এবং এতে ভারসাম্যমূলক রাজনৈতিক সমাধানের সম্ভাবনা বিলীন হতে পারে। আমি মনে করি, প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবে ভালো কিছু দিক আছে, কিন্তু এর চেয়ে উত্তম প্রস্তাব দেওয়ার সুযোগ অবশ্যই তাঁর ছিল।
প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনকালে সর্বদলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন, এটি খুব অভিনন্দনযোগ্য। তিনি আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনের তারিখ ঠিক করার কথা বলেছেন, এটিও আশাব্যঞ্জক। কিন্তু সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সবচেয়ে যা জরুরি, তা হচ্ছে নির্বাচনকালীন (সর্বদলীয় বা অন্য যেকোনো) সরকারের প্রধান যিনি হবেন, তাঁর নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা। শেখ হাসিনা তাঁর ভাষণে এই সরকারের প্রধান হিসেবে তাঁর বদলে অন্য কাউকে নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ আছে, এমন কোনো ইঙ্গিত প্রদান করেননি। তিনি যদি এ নিয়ে আলোচনার সুযোগ আছে বলতেন বা অদূর ভবিষ্যতেও যদি বলেন, তাহলেই একটি সত্যিকারের সমাধানের পথ প্রশস্ত হবে। তিনি তা কখনো বলেননি। তাঁর সর্বশেষ ভাষণ শুনে বরং মনে হয়েছে, নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে তিনি নিজেই বহাল থাকবেন। যদি তা-ই হয়, তাহলে সেই সরকারে বিএনপির মন্ত্রীরা থাকলেও তাঁরা নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারবেন, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। সর্বদলীয় সরকার গঠনের উদ্দেশ্য যদি হয় নির্বাচনকালে সরকারের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা, তাহলে শেখ হাসিনা (বা খালেদা জিয়ার) নেতৃত্বাধীন ‘সর্বদলীয় সরকার’ তা করতে পারবে—এই ধারণার তেমন কোনো ভিত্তি নেই।
আমরা এ প্রসঙ্গে ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অভিজ্ঞতা স্মরণ করতে পারি। সেই সরকারের প্রধান ছিলেন একজন অরাজনৈতিক, কিন্তু বিএনপির মনোনীত রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ। তিনি বিএনপির কথা অনুসারে চলতেন বলে বাকি উপদেষ্টারা নিরপেক্ষ ও নির্দলীয় হওয়া সত্ত্বেও সেই সরকার নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে ব্যর্থ হচ্ছিল। একপর্যায়ে সেই সরকার ভেঙে দিয়ে নিরপেক্ষ একজন ব্যক্তিকে প্রধান করে নির্বাচনকালীন সরকার পুনর্গঠন করতে হয়েছিল। বিএনপিপন্থী ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান হয়ে যেমন এককভাবে সরকার চালিয়েছিলেন, আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র নেত্রী শেখ হাসিনা আগামী নির্বাচনের জন্য সর্বদলীয় সরকারের প্রধান হলে তাঁর পক্ষেও বিএনপির দু-চারজন মন্ত্রীর মতামত উপেক্ষা করে সরকার পরিচালনা করা সম্ভব হবে। ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদের পক্ষে সংবিধান, রাজনৈতিক দল ও অনুগত মন্ত্রী কিছুই ছিল না। শেখ হাসিনার পক্ষে বর্তমান সংবিধান, আওয়ামী লীগ ও মহাজোট এবং সর্বদলীয় সরকারের অধিকাংশ মন্ত্রী থাকার কারণে আরও বাধাহীনভাবে বিএনপির মন্ত্রীদের উপেক্ষা করা সম্ভব হবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে সরকারের সব ক্ষমতার মালিক আসলে প্রধানমন্ত্রী। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিকে ভারতের মতো মন্ত্রিসভার পরামর্শ অনুসারে নয়, প্রধানমন্ত্রীর একক পরামর্শ অনুসারে কাজ করতে হয়। অন্য মন্ত্রীদের মন্ত্রিত্ব সম্পূর্ণভাবে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছাধীন বলে তাঁরাও প্রধানমন্ত্রীর কথার বাইরে একচুল নড়তে পারেন না। প্রধানমন্ত্রী সংসদ নেত্রী বলে কার্যত সংসদেরও প্রধান। তিনি একচ্ছত্রভাবে দলীয় প্রধান বলে কে স্পিকার হবেন বা কে রাষ্ট্রপতি হবেন—এগুলোসহ সব রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত তিনিই কার্যত নির্ধারণ করেন। আবার দলীয়করণ প্রক্রিয়ায় মূলত প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমেই ঠিক হয় জনপ্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনে গুরুত্বপূর্ণ পদে কারা আসীন থাকবেন। এমন একটি সরকারকাঠামোতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন নির্বাচনকালীন সরকার (তা যদি সর্বদলীয় সরকারও হয়) নিরপেক্ষভাবে কাজ করবে, এটা যে প্রধান বিরোধী দল বিশ্বাস করবে, তা আশা করা বাস্তবোচিত নয়। ১৯৯৬ সালে তখনকার বিরোধী দল আওয়ামী লীগ সে কারণেই প্রস্তাবিত সর্বদলীয় সরকারের প্রধান খালেদা জিয়া হবেন, এটি কিছুতেই মেনে নেয়নি। তখনকার আওয়ামী লীগের অবস্থানকে যে কারণে নাগরিক সমাজ যৌক্তিক মনে করেছিল, একই কারণে এখনো আমাদের বোঝা উচিত, কেন এমন একটি সরকারের প্রধান পদে আওয়ামী লীগের নেত্রীকে বিএনপির পক্ষে মেনে নেওয়া দুষ্কর।
রফিক-উল হক বলেছেন, ‘(সর্বদলীয় সরকারের) মন্ত্রিপরিষদ চাইলে শেখ হাসিনা সরকারপ্রধান থাকবেন, না চাইলে অন্য কেউ থাকবেন। বিষয়টি নিয়ে আর বিতর্ক করার সুযোগ নেই। এতে সমস্যা আরও বাড়বে।’ আমি সবিনয়ে বলছি, এ নিয়ে এখনই আলোচনা ও নিষ্পত্তি না হলেই বরং সমস্যা আরও বাড়বে। সর্বদলীয় সরকার হলে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি, অবধারিতভাবে তারা শেখ হাসিনাকেই সরকারপ্রধান হিসেবে চাইবে। সে ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন অধিকাংশ আওয়ামী লীগ সদস্যসংবলিত নির্বাচনকালীন সরকার নিরপেক্ষভাবে কাজ করবে—এটি বিএনপির জন্য বিশ্বাস করা কি ইতিহাসসম্মত হবে? আর নির্বাচনকালীন সরকারে যদি সরকার ও বিরোধী দলের সমান সদস্য থাকেন, তাহলে তাঁরা কি শেখ হাসিনাকে সেই সরকারের প্রধান না করার ব্যাপারে একমত হবেন? বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে তা আদৌ সম্ভব কি?
আমি রফিক-উল হকের সঙ্গে একমত যে সংঘাত এড়ানোর স্বার্থে বিএনপির উচিত তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় সরকারের দাবি থেকে সরে এসে সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব গ্রহণ করা এবং স্পষ্টভাবে বলা যে এই সরকারের প্রধান হিসেবে একজন গ্রহণযোগ্য নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে মনোনীত করতে হবে। আওয়ামী লীগের উচিত এ লক্ষ্যে অবিলম্বে আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া। সংবিধানকাঠামোর মধ্যেই এ প্রশ্নের সুরাহা সম্ভব। সংবিধানের আলোকে সর্বদলীয় সরকারে ফজলে হাসান আবেদ, বিচারপতি মাহমুদূল আমীন চৌধুরী অথবা আকবর আলি খানের মতো এক বা একাধিক নিরপেক্ষ নির্দলীয় ব্যক্তিকে রাখা সম্ভব। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি চাইলে কোনো উপনির্বাচনের মাধ্যমে সেই নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচিত করে আনাও সম্ভব। সে ক্ষেত্রে তাঁকে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান করার পথে আর কোনো সাংবিধানিক বাধাও থাকবে না।
নির্দলীয় ব্যক্তি প্রশ্নে সমঝোতা না হলে প্রধান দুই দল সংসদে একমাত্র স্বতন্ত্র সদস্য ফজলুল আজিমকে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান করা যায় কি না, তা-ও ভেবে দেখতে পারে। সর্বদলীয় সরকারের প্রধান সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হলে নির্বাচন নিয়ে অন্যান্য সংকট (যেমন: নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা, নির্বাচনের সময়, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি ইত্যাদি) দূর করা সহজতর হবে।
আমার মনে হয় না, সর্বদলীয় সরকারে প্রধানমন্ত্রী কে হবেন, এই প্রশ্নে দুই দলের সমঝোতা না হলে সবার অংশগ্রহণে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা সম্ভব হবে। এ নিয়ে তাই আলোচনা শুরু করা উচিত এখনই। ২৫ অক্টোবরের পর থেকে দেশে বিরাজমান রাজনৈতিক সংকটের সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে সাংবিধানিক সংকটও শুরু হবে। দুই প্রধান দলের সমঝোতায় পৌঁছাতে যত দেরি হবে, এই সংকট ততই ঘনীভূত হবে।

AD BANNAR