বাংলাদেশের লাক্স চ্যানেল আই সুপারস্টার
প্রতিযোগিতার এক পর্বে একটি মেয়ে শাড়ির ওপর ব্লাউজ পরেছে। সাধারণত আজকাল
ব্লাউজের ওপর শাড়ি পরে মেয়েরা। শাড়ির ওপর ব্লাউজ পরাটা আমার বেশ লেগেছে।
আইডিয়াটা একেবারেই নতুন। মেয়েটির নাকি ফ্যাশন ডিজাইনারের- আইডিয়াটা ঠিক কার
মাথা থেকে এসেছে, জানতে ইচ্ছে করছে খুব। শাড়ির ওপর পেটিকোট পরলেও হয়তো
ভালো দেখাবে। অথবা পেটিকোটটা বুকের ওপর বেঁধে দিলে! শাড়িটাকে স্কার্টের মতো
পরলে! ব্লাউজকে বাজুবন্ধ বানালে! কতভাবেই তো কাপড়-চোপড় পরা যায়। পেটিকোট
পরার চলটাই তো নতুন। কুঁচি দিয়ে শাড়ি পরাটাও নতুন।
এ অঞ্চলে শাড়িটাই বা কবে এসেছে! একসময়
নারী পুরুষ উভয়েই ধুতি পরতো। দক্ষিণ ভারতে পুরুষের মতো লুঙ্গিও পরতো
নারীরা। প্রাচীন ভারতের নারীরা বুকের ওপর কিছুই পরতো না, অথবা পরলেও ওড়না
পরতো নয়তো বক্ষবন্ধনী পরতো। কাপড়গুলোয় কোনও সেলাই ছিল না। হিন্দুদের মধ্যে
সেলাইবিহীন কাপড় পরার চল ছিল। সেলাই করা কাপড়কে, আমি ঠিক জানি না কী কারণে,
অপবিত্র বলে ভাবা হত। ধুতি থেকে ধীরে ধীরে শাড়ি এসেছে, শাড়ির নাম তখন শাড়ি
ছিল না, ছিল সাত্তিকা। সংস্কৃত শব্দ সাত্তিকা থেকে এলো সাতি, সাতি থেকে
সাডি, সাডি থেকে সাড়ি, সাড়ি থেকে শাড়ি। উড়িষ্যায় ‘মাছের লেজের স্টাইল’ এলো
সতেরো শতকে । ‘মাছের লেজের স্টাইল’ এরকম: দুটো পা'কে ধুতির অর্ধেকটা দিয়ে
পেঁচিয়ে বাকিটা মাছের লেজের মতো কাঁধ থেকে ঝুলিয়ে দেওয়া। লেজটা আঁচল।
মেয়েদের ধুতিটাই ধীরে ধীরে এভাবে মেয়েদের শাড়িতে রূপান্তরিত হয়।
আমরা এ যুগের নারীরা ব্লাউজের ওপর আঁচল ব্যবহার করছি। আজকের স্টাইল যে বাকি জীবনের জন্য স্থির হয়ে গিয়েছে, তা নয়। এই স্টাইলটাও একসময় বিদেয় হবে, নতুন কোনও স্টাইল আসবে। মানুষ চিরকালই নতুন নতুন স্টাইলের আইডিয়া দেয় । শাড়ির ওপর ব্লাউজ পরেছে মেয়ে, পরুক। তোমার পছন্দ না হলে পরো না।
ইংরেজ আসার পর ব্লাউজ পেটিকোট পরা শুরু হয়েছে। মুসলমানরা ঘাগড়া নিয়ে
এসেছিল। সেই ঘাগড়া দেখেই পেটিকোট সেলাইয়ের শুরু। ভারতবর্ষের শাড়ির ইতিহাসই
আমাদের শাড়ির ইতিহাস। হিন্দুরাই আমাদের পুর্বপুরুষ এবং পূর্বনারী। আমরা তো
বাঙালি জাতি হিসেবে একাত্তর সালে জন্ম নিইনি। বাঙালি হাজার বছরের পুরোনো
জাতি। শাড়ির বিবর্তনের ইতিহাস যারা জানে, শাড়ির যে কোনও বিববর্তনই গ্রহণ
করতে তাদের অসুবিধে হওয়ার কথা নয়।
আমাদের পূর্বনারীদেরও পূর্বনারীরা ন্যাংটো থাকতো, গাছের ছাল পরতো,
জন্তুর চামড়া পরতো, তারপর শুরু করল কাপড় পরা। আমরা এ যুগের নারীরা ব্লাউজের
ওপর আঁচল ব্যবহার করছি। আজকের স্টাইল যে বাকি জীবনের জন্য স্থির হয়ে
গিয়েছে, তা নয়। এই স্টাইলটাও একসময় বিদেয় হবে, নতুন কোনও স্টাইল আসবে।
মানুষ চিরকালই নতুন নতুন স্টাইলের আইডিয়া দেয় । শাড়ির ওপর ব্লাউজ পরেছে
মেয়ে, পরুক। তোমার পছন্দ না হলে পরো না। যেমন আমি পরবো না। খুব স্লিম হলে
হয়তো পরতাম। আমি কখনও চলতি কোনও ফ্যাশন মেনে চলি না। আমার ফ্যাশনের নাম,
‘যখন যা খুশি’। ক্যাজুয়ালের চূড়ান্ত। কাপড় চোপড় আমি ইস্ত্রি করি না বললেই
চলে। হাতের কাছে যা পাই তাই পরি। শার্ট প্যান্ট, শর্টস টিশার্ট, অথবা শাড়ি।
মূলত সুতি শাড়ি। আজকাল আর সালোয়ার কামিজ, স্কার্ট ফার্ট পরি না। 'মেয়েলি'
জিনিস পরতে ভালো লাগে না। যে অর্থে কোনও পোশাককে লোকেরা মেয়েলি বলে, আমি
সেই অর্থেই বলছি। শাড়িকে আমার একেবারই মেয়েলি বলে মনে হয়না। শাড়ি কিন্তু
আমার হাঁটা চলাকে ধীর করে না, শার্টপ্যান্টজুতো পরে যেভাবে দ্রুত হাঁটি,
শাড়ি পরেও। শাড়ি মেয়েলি? ধুতি পরা পুরুষগুলোকে কি মেয়েলি দেখতে লাগে?
পুরুষালি, মেয়েলি---এই ধারণাগুলো বদলোকের বানানো। শাড়ির মতো পোশাক পরা
প্রাচীন গ্রীসের ওই ব্যক্তিত্বশালী রাজাদের কি আদৌ মেয়েলি বলে মনে হয়? আজ
থেকে পুরুষরা যদি শাড়ি পরা শুরু করে, আর মেয়েরা শার্টপ্যান্ট, তাহলে খুব
বেশি দিন পার হবে না, যখন মানুষ বলতে শুরু করবে শাড়ি খুব পুরুষালি পোশাক,
আর শার্টপ্যান্ট মেয়েলি। পুরুষালি আর মেয়েলিতে কিন্তু অসুবিধে নেই। অসুবিধে
তখনই, যখন পুরুষালি কিছুকে মেয়েলি কিছুর চেয়ে সুপিরিওর বলে মনে করা হয়।
কাপড় পরা মানুষদের মধ্যে একজন যদি কাপড় খুলে দাঁড়ায় তাকে খুব অশ্লীল দেখাবে, এ কথা সবাই জানে। আবার কাপড়ও কিন্তু কখনও কখনও বড় অশ্লীলতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
কোনও পোশাকই অশ্লীল নয়। আবার পোশাকহীনতাও অশ্লীল নয়। আমাজনের জঙ্গলে বা আন্দামান দ্বীপে আদিবাসীরা যখন উলঙ্গ ঘোরাফেরা করে, ওদের কি অশ্লীল দেখায়? অশ্লীলতার সংজ্ঞা আমরা তৈরি করেছি। সংজ্ঞাটা অশ্লীল। মানুষের কুৎসিত মনটা অশ্লীল। যে মনটা ভাবে, মেয়েরা যৌন বস্তু, কিন্তু পুরুষ যৌন বস্তু নয়, সুতরাং মেয়েরা কী পরবে না পরবে সেই সিদ্ধান্ত পুরুষ নেবে, যে মেয়েরা পুরুষের পছন্দমতো পোশাক পরেনা, সেই মেয়েরা চরিত্রহীনা---সেই মনটা অশ্লীল। যে মনটা ভাবে, স্বল্প কোনও পোশাক পরা মানে ধর্ষিতা হওয়ার জন্য মেয়েদের সম্মতি দেওয়া--- সেই মনটা অশ্লীল। যে মনটা ভাবে পুরুষ যা খুশি পরুক, মেয়েরা যেন যা খুশি না পরে--- সেই মনটা অশ্লীল।
কাপড় পরা মানুষদের মধ্যে একজন যদি কাপড় খুলে দাঁড়ায় তাকে খুব অশ্লীল
দেখাবে, এ কথা সবাই জানে। আবার কাপড়ও কিন্তু কখনও কখনও বড় অশ্লীলতার কারণ
হয়ে দাঁড়ায়। কয়েক বছর আগের এক গ্রীষ্মকাল আমি বার্লিনে কাটিয়েছি। কোনও এক
বিকেলে বাড়ির খুব দূরে নয় এমন এক ঝিলে সাঁতার কাটার উদ্দেশে হাঁটতে হাঁটতে
ঝিলের পাড় ঘেঁষা মাঠে গিয়ে চমকে উঠেছিলাম, রাস্তার কিনারেই সেই খোলা মাঠ,
আর মাঠ জুড়ে শত শত উলঙ্গ --সম্পূর্ণ উলঙ্গ--নারী পুরুষ-কিশোরী-কিশোরী আর
শিশু শুয়ে আছে, বসে আছে। সবাই রোদ তাপাচ্ছে, আর ক্ষণে ক্ষণে উঠে ঝিলের জলে
সাঁতার কেটে আসছে। সারাদিনের খাবার আর জলটল সঙ্গে এনেছে। ওখানেই সপরিবার
খাচ্ছে। আমি সবার মাঝখানে, গায়ে প্রচুর কাপড় আমার। আমার দিকে সবাই বিস্মিত
চোখে তাকাচ্ছে। অনেকটা কৌতুকের চোখেও। কিছু চোখে প্রচ্ছন্ন বিরক্তি। আমাকে,
সত্যি বলতে কী, আমি নিজেও বুঝতে পারছিলাম, অশ্লীল দেখাচ্ছে। শরীরে কাপড়
থাকার লজ্জায় আমি মাথা নিচু করে রইলাম। উলঙ্গ মেয়েরা যেমন লজ্জায় দু’হাতে
বুক আড়াল করে, সেরকম আমিও শরীরে কাপড় থাকার লজ্জায় দু’হাতে কাপড় আড়াল করতে
চাইছিলাম।
সভ্য মানুষেরা জানে কী করে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় কামনা। অসভ্যরা যারা জানে না, তাদের সভ্য করার ব্যবস্থা হোক। মেয়েদের গায়ে বোরখা চাপালে, অসভ্যকে সভ্য করার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা হয়।
অগত্যা এক এক করে কাপড় খুলে ফেললাম, কিন্তু জনসমক্ষে আন্ডারওয়ারগুলো
অনেকবার খুলতে চেষ্টা করেও খুলতে পারিনি। কোথাকার এক আড়ষ্টতা আমাকে শামুক
বানিয়ে রেখেছিল। এরকম নয় যে ওই মাঠে আমার চেনা কেউ ছিল। এক মাঠ অচেনা উলঙ্গ
মানুষের সামনেও আমি উলঙ্গ হতে পারিনি। ভেবেছিলাম আমিও রোদ তাপাবো, সাঁতার
কাটবো। কিন্তু সম্পূর্ণ উলঙ্গ হতে না পারার লজ্জায় শেষ পর্যন্ত ওই মাঠ থেকে
সরে যেতে আমি বাধ্য হয়েছিলাম। শত শত উলঙ্গ নারী পুরুষকে সেদিন একফোঁটা
অশ্লীল লাগেনি, আমাকে বরং অশ্লীল লেগেছিল দেখতে। অশ্লীলতাবোধটা মানসিক। এর
সঙ্গে পোশাকের কোনও সম্পর্ক নেই। গায়ে পোশাক থাকলে অশ্লীল লাগছে বলে মনে
হতে পারে, না থাকলেও তা মনে হতে পারে।
কোনও পোশাককে আমি অশ্লীল বলে মনে করি না। তবে তথাকথিত অশ্লীলতা দূর
করতে যে পোশাকগুলো বানানো হয়েছে, এবং মেয়েদের গায়ে চাপানো হয়েছে, মেয়েদের
স্বাধীনতা আর স্বতঃস্ফূর্ততাকে কবর দিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেই পোশাকগুলোকে বরং
আমার ভীষণ অশ্লীল বলে মনে হয়। যেমন হিজাব, যেমন বোরখা।
মাঝে মাঝে, আমি বুঝি না, মেয়েদের বুক কেন ঢেকে রাখতে হবে নানারকম কাপড়
দিয়ে। ব্রা পরো, তার ওপর ব্লাউজ পরো, তার ওপর শাড়ি পরো, অথবা জামা পরো,
তার ওপর ওড়না পরো বা তার ওপর চাদর পরো, তার ওপর বোরখা পরো। লোকেরা যেন না
জানে স্তন বলে শরীরে কিছু আছে মেয়েদের। যদি বাইরে থেকে বোঝা যায় স্তন বলে
কিছু আছে, তবে সর্বনাশটা কেন হবে। অসমকামী পুরুষের যৌন কামনা জাগবে। তা
জাগুক। জাগাটাই তো স্বাভাবিক। ঠিক যেমন স্বাভাবিক, পুরুষদের দেখে নারীর
যৌনকামনা জাগা!
বাংলাদেশের সমাজ এখনও অন্ধকারে। বড় বড় অট্টালিকা, দামি দামি গাড়ি, উঁচু উঁচু শপিং সেন্টার –কিছুরই অভাব নেই, সুস্থ মানসিকতারই শুধু অভাব। তাই কোনও মেয়ে শাড়ির ওপর ব্লাউজ পরলে বিরাট বিতর্ক শুরু হয়। অনেক স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় আছে দেশে, কিন্তু খুব কম মানুষই এ দেশে ‘শিক্ষিত’।
কিন্তু এ কথা ভুললে চলবে না যে সভ্য হওয়ার জন্য আমরা কিছু নিয়ম তৈরি
করেছি, যেমন: তোমার যৌনকামনা জাগলেই তুমি কারও ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারো না,
যৌনসম্পর্ক করার জন্য তোমাকে তার সম্মতি পেতে হবে আগে। এই নিয়মটি পালন না
করে মেয়েদের কিনা বোরখা পরানো হচ্ছে। তাদেরকে সমাজ থেকে ব্ল্যাকআউট করা
হচ্ছে। জলজ্যান্ত মানুষগুলোকে এক একটা আস্ত কারাগার বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যে
পুরুষের যৌন কামনা জাগে, বোরখা পরা মেয়ে দেখলেও তার যৌন কামনা জাগে। আর
যার জাগে না, তার উলঙ্গ মেয়ে দেখলেও জাগে না।
সভ্য মানুষেরা জানে কী করে নিয়ন্ত্রণ করতে হয় কামনা। অসভ্যরা যারা
জানে না, তাদের সভ্য করার ব্যবস্থা হোক। মেয়েদের গায়ে বোরখা চাপালে,
অসভ্যকে সভ্য করার প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা হয়।
বাংলাদেশের সমাজ এখনও অন্ধকারে। বড় বড় অট্টালিকা, দামি দামি গাড়ি,
উঁচু উঁচু শপিং সেন্টার –কিছুরই অভাব নেই, সুস্থ মানসিকতারই শুধু অভাব। তাই
কোনও মেয়ে শাড়ির ওপর ব্লাউজ পরলে বিরাট বিতর্ক শুরু হয়। অনেক স্কুল কলেজ
বিশ্ববিদ্যালয় আছে দেশে, কিন্তু খুব কম মানুষই এ দেশে ‘শিক্ষিত’। কলেজ
বিশ্ববিদ্যালয়ে পরে আজকাল মানুষ ডিগ্রিধারী অশিক্ষিত বনে, নয়তো মৌলবাদী আর
সন্ত্রাসী বনে। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় কাউকে সত্যিকার শিক্ষিত করে না।
‘শিক্ষিত’ হতে হয় নিজের চেষ্টায়, নিজের বুদ্ধিতে, মানবাধিকার আর
সমানাধিকারে বিশ্বাস করে এবং নিজের জীবনে নিজের বিশ্বাসের চর্চা করে।
আমরা এই মহাশূন্যে ভাসতে থাকা কোটি কোটি গ্রহের মধ্যে একটি অতি
ক্ষুদ্র গ্রহে জন্ম নিয়েছি। কোটি কোটি বছর ধরে এককোষী প্রাণীর বিবর্তন ঘটতে
ঘটতে মানুষ নামক প্রাণীর ঘটনা ঘটেছে। কোনও একদিন আমরাও কোটি কোটি প্রাণীর
মতোই বিলুপ্ত হয়ে যাবো। আমাদের এবং আমাদের পোশাক নিয়ে বিশ্ব ব্রম্মাণ্ডের
কোনও মাথা ব্যথা নেই। মাথা ব্যথা শুধু নারী-বিদ্বেষী কিছু নিকৃষ্ট মানুষের।
মেয়েদের শরীরে অশ্লীল লোকেরা কেবল অশ্লীলতা আবিষ্কার করে। মেয়েদের হাসিতে,
মেয়েদের তাকানোয়, মেয়েদের কথা বলায়, মেয়েদের হাঁটাচলায়, মেয়েদের ব্যবহারে
অশ্লীলতা আবিষ্কার করার লোক কিলবিল করছে সমাজে। অশ্লীলতা নিষিদ্ধ হোক আমি
চাই। অশ্লীল লোকগুলোর অশ্লীল মন মানসিকতা নিষিদ্ধ হোক চাই। নোংরামো দূর হোক
চাই। মেয়েদের স্বাধীনতা আর অধিকারের বিরুদ্ধে কুৎসিত ষড়যন্ত্র চিরকালের
জন্য দূর হোক চাই।
প্রকাশিত:
সম্পাদিত: