Boxed Style

আইফোন জিতে ক্লিক করুন

Tuesday 28 October 2014

লতিফ সিদ্দিকী এমপি পদও হারাচ্ছেন

সংসদ সদস্যপদ হারাতে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেতা ও বরখাস্ত হওয়া মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী এমপি।

মসিউর রহমান খান
সংবিধান ও আইনে সুস্পষ্ট নির্দেশনা না থাকলেও নির্বাচনী আইনের একটি ধারার আওতায় সংসদ সদস্যপদ হারাতে যাচ্ছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেতা ও বরখাস্ত হওয়া মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী এমপি। এ জন্য প্রয়োজনীয় আইনি পদক্ষেপ গ্রহণে গতকাল সোমবার স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সঙ্গে বৈঠক করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এমপি।     লতিফ সিদ্দিকী এমপি পদও হারাচ্ছেন
আজ মঙ্গলবার যে কোনো সময় দলীয় সিদ্ধান্ত জানিয়ে সৈয়দ আশরাফ স্বাক্ষরিত চিঠি স্পিকারের দপ্তরে পাঠানো হচ্ছে। এর পর স্পিকার বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের (ইসি) কাছে পাঠিয়ে দেবেন। সেখানেই এর চূড়ান্ত ফয়সালা হবে। এর আগে সপ্তম সংসদে আদালতের নির্দেশে স্পিকার দু'জন সংসদ সদস্যের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য ইসির কাছে পাঠান। ইসি ওই দু'জনের সদস্যপদ শূন্য ঘোষণা করে গেজেট প্রকাশ করে।
লতিফ সিদ্দিকীর সদস্যপদের বিষয়ে জানতে চাইলে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী সমকালকে বলেন, সংবিধানে উলি্লখিত যেসব কারণে সদস্যপদ শূন্য হওয়ার সুযোগ রয়েছে, আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর ক্ষেত্রে তা সরাসরি প্রযোজ্য নয়। তিনি পদত্যাগ করেননি বা দলের বিপক্ষে ভোট দেননি। দল থেকে বহিষ্কারের বিষয়ে সংবিধানে কিছু বলা নেই। তবে তার ক্ষেত্রে আরপিওর (গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২) ১২ ধারা কার্যকর হতে পারে।
গতকাল বিকেলে সংসদ ভবনে সমকালের সঙ্গে আলাপকালে সৈয়দ আশরাফ জানান, এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে স্পিকারের সঙ্গে তিনি বৈঠক করেছেন। চিঠি খসড়া প্রস্তুত রয়েছে। সংসদ ভবন থেকে গিয়েই তিনি স্বাক্ষর করবেন। এর পর তা স্পিকারের কাছে পাঠানো হবে। স্পিকার বিষয়টি নির্বাচন কমিশনে পাঠিয়ে দেবেন। সংবিধান অনুযায়ী এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার একমাত্র এখতিয়ার নির্বাচন কমিশনের।
এর আগে ২৪ অক্টোবর গণভবনে দলীয় বৈঠক থেকে বেরিয়ে সৈয়দ আশরাফ সাংবাদিকদের জানান, লতিফ সিদ্দিকীর বিষয়ে দলীয় সিদ্ধান্ত ইসিতে পাঠানো হবে। তবে নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবদুল মোবারক জানিয়েছেন, দলীয় চিঠি আমলে নেওয়ার সুযোগ ইসির নেই। স্পিকারের দপ্তর থেকে চিঠি এলে কমিশন বৈঠকে বসে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। লতিফ সিদ্দিকীর সদস্যপদ বাতিল হচ্ছে কি-না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি এখনও কমিশনের বিবেচনার বাইরে। আগে কমিশনের কাছে আসুক, তার পর দেখা যাবে।
সংসদ সচিবালয় সূত্র জানিয়েছে, এর আগে বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্যকে দল থেকে বহিষ্কার করা হলেও তাদের সদস্যপদ বহাল থাকার নজির রয়েছে। আবার সপ্তম সংসদে বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত দু'জন এমপির পদ বাতিলের নজিরও রয়েছে। অষ্টম সংসদে বিএনপির একজন ও নবম সংসদে জাতীয় পার্টির একজন সদস্যকে দল থেকে বহিষ্কারের পরও তাদের সদস্যপদ বহাল ছিল। এমনকি অষ্টম সংসদের স্পিকার ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার ও নবম সংসদের স্পিকার অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ বিষয়টি ইসিতেও পাঠাননি।
এ ব্যাপারে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, আগের দুই স্পিকার কেন বিষয়টি ইসিতে পাঠাননি, তা খতিয়ে দেখার বিষয় রয়েছে। আইনগত দিক পর্যালোচনার আগে এ বিষয়ে মন্তব্য করা ঠিক হবে না। দল থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পরও অষ্টম সংসদে রাজশাহী-৩ আসন থেকে নির্বাচিত বিএনপির সদস্য আবু হেনার সদস্যপদ বহাল রাখার বিষয়ে তৎকালীন স্পিকার ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার বলেছিলেন, জনগণের ইচ্ছায় একজন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। জনগণ স্বাধীন ও সার্বভৌম। তাদের রায়ের প্রতি অসম্মান জানিয়ে কারও সদস্যপদ বাতিলের এখতিয়ার কোনো দল বা সংসদের থাকতে পারে না। এ ছাড়া নবম সংসদে সাতক্ষীরা-৪ আসন থেকে নির্বাচিত জাতীয় পার্টির সদস্য গোলাম রেজাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হলেও সদস্যপদ বহাল থাকে।
সংসদ সচিবালয় সূত্র জানিয়েছে, অষ্টম সংসদের সময় যদিও আরপিওর সংশ্লিষ্ট ধারাটি ছিল না। ২০০৮ সালে অধ্যাদেশ জারি করে এই ধারা আরপিওতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরে এটি নবম সংসদে পাস হয়। সংসদের আইন শাখার এক কর্মকর্তা বলেন, আবদুল লতিফ সিদ্দিকীর জন্য সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ প্রযোজ্য হয়নি, এটা ঠিক। কিন্তু 'সংসদে নির্বাচিত হওয়ার যোগ্যতা ও অযোগ্যতা'র ক্ষেত্রে ৬৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, 'কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার বা থাকার যোগ্য হবেন না, যদি তিনি কোনো আইনের দ্বারা বা অধীন অনুরূপ নির্বাচনের অযোগ্য হন।'
এই অনুচ্ছেদের আওতায় লতিফ সিদ্দিকীর বিষয়টি আরপিও, ১৯৭২-এর ১২(১) ধারা কার্যকর হবে। কারণ, ওই ধারার শর্তাংশে বলা হয়েছে, 'কোনো ব্যক্তি সদস্য নির্বাচিত হওয়ার এবং সদস্য থাকার যোগ্য হবেন না, যদি_ (খ) তিনি কোনো নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মনোনীত না হন অথবা একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী না হন।' অর্থাৎ যে দল থেকে মনোনয়ন পেয়েছিলেন, সে দল থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার মধ্য দিয়ে তিনি এখন আর কারও মনোনীত নন। আর স্বতন্ত্র সদস্য হওয়ার ক্ষেত্রে আরপিওতে সুনির্দিষ্ট বিধান রয়েছে। তিনি তার আওতায় পড়বেন না।
এদিকে, ইসি সচিবালয়ের আইন শাখার কর্মকর্তারাও একই ধরনের মত প্রকাশ করেছেন। তারা আরও বলেছেন, ১৯৯৯ সালের ২৯ জুলাই উচ্চ আদালতের একটি রায় এবং ওই বছরেরই ১১ অক্টোবর ইসির একটি সিদ্ধান্তের নজির তাদের কাছে রয়েছে। লতিফ সিদ্দিকীর বিষয়টি কমিশনের কাছে এলে এর আলোকেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে।
সপ্তম সংসদে বিএনপির টিকিটে সিরাজগঞ্জ-৭ থেকে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন হাসিবুর রহমান স্বপন এবং রাজশাহী-৫ আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন ডা. আলাউদ্দিন। পরে তারা আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভায় যোগ দেন। কিন্তু তৎকালীন স্পিকার হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী এক রুলিংয়ে বলেন, তারা মন্ত্রিসভায় যোগ দিলেও দল থেকে পদত্যাগ করেননি বা দলের বিরুদ্ধে ভোট দেননি। তাদের সদস্যপদ বহাল থাকবে। বিএনপির পক্ষ থেকে বিষয়টি নিয়ে আদালতে চ্যালেঞ্জ করা হয়।
উচ্চ আদালতের ওই রায়ে বলা হয়েছে, সংবিধান অনুসারে এ বিষয়ে স্পিকার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। এর এখতিয়ার শুধু নির্বাচন কমিশনের। এর পর নির্বাচন কমিশন ১৯৯৯ সালের ১১ অক্টোবর এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানায়। কমিশনের পর্যবেক্ষণ ছিল, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের চেতনা (স্পিরিট) অনুসারে ওই দুই সংসদ সদস্য যে দলের মনোনয়নে নির্বাচিত হয়েছিলেন, সেই দলের প্রতি তাদের আনুগত্য বজায় রাখেননি। এটি দলের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা। এ ধরনের ঘটনায় সংসদীয় পদ্ধতির কর্মসম্পাদনে প্রতিকূল প্রভাব ফেলে। তারা বিএনপি থেকে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের পক্ষে তাদের আনুগত্য পরিবর্তন করেছেন। বিষয়টি দল থেকে পদত্যাগেরই সমার্থক। কমিশন ৬৭(১)(ই) ও ৭০(১) অনুচ্ছেদ অনুসারে ওই দুই এমপির আসন শূন্য ঘোষণার আদেশ জারি করে।
ইসি সচিবালয় সূত্র আরও জানায়, হাসিবুর ও আলাউদ্দিনের আগে ১৯৯৬ সালে বিতর্কিত ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের আগে বিএনপিতে যোগ দিয়ে সংসদ সদস্যপদ হারিয়েছিলেন জাতীয় পার্টির চার সদস্য। সংবিধানের ৬৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে এ বিষয়ে তখন নির্বাচন কমিশনই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।