Boxed Style

আইফোন জিতে ক্লিক করুন

Sunday 1 December 2013

আ. লীগের মনোনয়ন অদৃশ্য ইশারায় বদলে যাচ্ছে প্রার্থী

পাভেল হায়দার চৌধুরী

মনোনয়ন চূড়ান্ত করে আনুষ্ঠানিকভাবে নাম ঘোষণার পরও আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালিকায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। ঘোষিত প্রার্থীর নাম বাদ দিয়ে ঢোকানো হয়েছে আনকোরা নাম। সংসদীয় বোর্ডের বিবেচনায় চূড়ান্তভাবে মনোনীত প্রার্থী বদলের ঘটনায় হতাশ হচ্ছেন শেষ মুহূর্তের বঞ্চিতরা, ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে তাঁদের কর্মী-সমর্থকরা। নির্বাচনের প্রার্থিতাকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্ব-সংঘাতের আশঙ্কা করছেন অনেকেই। এ ঘটনাকে অনিয়ম হিসেবেই দেখছেন তাঁরা। ‘চূড়ান্ত বিবেচনায় মনোনীত হওয়ার পরও কেন বঞ্চিত হব’- এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন প্রার্থীরা। আনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগে থেকে গত তিন দিন তদবিরের মাধ্যমে প্রায় এক ডজন প্রার্থী বদলের ঘটনা ঘটেছে বলে দলের সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা কালের কণ্ঠকে নিশ্চিত করেন।
এদিকে অদল-বদল নিয়ে জানতে চাইলে সংসদীয় বোর্ডের সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত কলের কণ্ঠকে বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমি কিছু বলব না।’ জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফও একই কথা বলেন।
সর্বশেষ গত শুক্রবার দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ধানমণ্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে বসে চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করেন। এর পরও দলের উপদপ্তর সম্পাদক স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে একাধিক প্রার্থী পরিবর্তনের মতো বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ ঘটনা ঘটেছে।
প্রার্থীদের অভিযোগ, আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে টেলিফোন করে চূড়ান্ত মনোনয়ন ফরম নিয়ে যাওয়ার জন্য খবর দেওয়া হলে তাঁরা ধানমণ্ডিতে দলীয় সভাপতির কার্যালয়ে আসেন। কেউ কেউ এসে সেই ফরমও হাতে পান। পরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা ও আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা মনোনীত ব্যক্তির হাতে তুলে দেওয়া ফরমে সমস্যা রয়েছে- এমন অজুহাত দিয়ে ফিরিয়ে নেন।
শুক্রবার আওয়ামী লীগের প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করেন দলের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। এ সময় তিনি ঝিনাইদহ-৩ (কোর্টচাঁদপুর-মহেশপুর) আসনে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে বর্তমান সংসদ সদস্য শফিকুল আজম খান চঞ্চলের নাম ঘোষণা করেন। পরে রাত ১০টার দিকে আওয়ামী লীগ কার্যালয় থেকে পাঠানো তালিকায় এ আসনে পরিবর্তিত প্রার্থীর নাম দেওয়া হয়। চঞ্চলের পরিবর্তে সেখানে বিকল্প দুজন প্রার্থীর নাম দেওয়া হয়। তাঁরা হলেন যুবলীগ নেতা অধ্যক্ষ নবী নেওয়াজ ও শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান সাজ্জাতুজ জুম্মা।
ঝিনাইদহ-৩ আসনের সংসদ সদস্য শফিকুল আজম চঞ্চল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘গত শুক্রবার মনোনয়নের ঘোষণার দিন আমি সংসদ ভবন এলাকায় ছিলাম। নাম ঘোষণার পর আমাকে জানানো হয় চূড়ান্ত ফরম নিয়ে যাওয়ার জন্য।’ তিনি বলেন, ‘আমি ধানমণ্ডি এসে ফরম তুলে স্বাক্ষর খাতায় সই করার সময় গণভবনের এক কর্মকর্তা ও আমাদের খুলনা বিভাগের এক নেতা (আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য) ফরমে সমস্যা আছে জানিয়ে আমার হাত থেকে তা ফিরিয়ে নেন। ওই সব নেতা আমাকে জানান, রাতে গণভবনে গিয়ে ফরম নিয়ে আসার জন্য।’
শফিকুল আজম চঞ্চল বলেন, ‘কথামতো গণভবনে গেলে আমাকে জানানো হয় প্রধানমন্ত্রী ওপরে উঠে গেছেন, আজ আর কথা হবে না। পরের দিন সকালে যেতে বলা হয়।’ তিনি বলেন, ‘রাতে জানতে পারি আমার আসনে নবী নেওয়াজ ও সাজ্জাতুজ জুম্মার নাম দিয়ে ধানমণ্ডির কার্যালয় থেকে প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয়েছে। এতে আমি ও আমার এলাকা থেকে আসা কর্মী-সমর্থকরা হতাশ হয়েছে।’
কোর্টচাঁদপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হতাশা প্রকাশ করে বলেন, শফিকুল আজম চঞ্চল নেতা-কর্মীদের সঙ্গে থেকে দলকে সংগঠিত করেছেন। তিনি এলাকায় থাকেন। তাঁকে মনোনয়ন দিলে দলের জন্য ভালো হতো।
ওই আসনে (কোর্টচাঁদপুর-মহেশপুর) মনোনয়ন পাওয়া দুই বিকল্প প্রার্থীর মধ্যে তুলনা করে মহেশপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ময়েজউদ্দিন হামিদ বলেন, সাজ্জাতুজ জুম্মার সঙ্গে এলাকার মানুষের সম্পর্ক রয়েছে। তিনি মনোনয়ন পেলেও ভালো প্রার্থী হিসেবে মানুষ গ্রহণ করত। নবী নেওয়াজের টাকা আছে, তাই তাঁকেই মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনে প্রথমে জেলা আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল্লাহ কবিরের নাম ঘোষণা করা হয়। পরের তালিকায় তাঁর নামের পরিবর্তে উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমানের নাম দেখা যায়। পার্বত্য চট্টগ্রাম খাগড়াছড়ি আসনে যতীন্দ্রলাল ত্রিপুরার নাম ঘোষণা করে পরে পুজেন্দ্র“ লাল ত্রিপুরার নাম সংযোজন করা হয়েছে। কুষ্টিয়া-৩ আসনে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফের নাম ঘোষণা করা হয়। পরে তাঁর নামের পাশে ডা. এ এফ এম আমিনুল ইসলাম রতনের নামও রাখা হয়। এ ছাড়া বরিশাল-২ আসনে অ্যাডভোকেট তালুকদার মো. ইউনুসের নাম ঘোষণা করা হয়। পরে মো. শাহে আলমের নাম যোগ করা হয়।
জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার বাসভবন গণভবন থেকে দলীয় মনোনয়ন চূড়ান্ত হয়ে আসার পরও তাঁর ধানমণ্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে তদবিরের কারণে বারবার আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীদের চূড়ান্ত তালিকায়ও পরিবর্তন এসেছে। এর আগে আওয়ামী লীগের এক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক ও কেন্দ্রীয় কমিটির এক সদস্য মনোনয়ন থেকে বাদ পড়লেও দলের সংসদীয় বোর্ডের কয়েকজনের তদবিরে তাঁরা নিজ নিজ আসনে মনোনয়ন ফিরে পান। এমন ঘটনা ঘটেছে ঢাকা-৪ আসনে মনোনয়নের ক্ষেত্রেও। জানা যায়, প্রথমে এ আসনে ড. আওলাদের মনোনয়ন চূড়ান্ত ছিল। এ খবর জানার পরও বর্তমান সংসদ সদস্য সানজিদা খানম বিভিন্ন উপায়ে তদবির করে নিজের মনোনয়ন ঠিক করেন। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে দলের কোনো পর্যায়ের নেতা সঠিক কোনো ব্যাখ্যা দেননি। এর আগেও চূড়ান্ত করার পরও বিভিন্নভাবে পরিবর্তন এসেছে মনোনয়নপ্রার্থীদের তালিকায়।
চট্টগ্রাম-১৬ (বাঁশখালী) আসনে নাম প্রকাশ না করার শর্তে আব্দুল্লাহ কবির সমর্থিত এক এক নেতা বলেন, ‘আমাদের প্রার্থীর নাম ঘোষণা করা হয় প্রথমে। জানতে পেরে ধানমণ্ডিতে আসি। ফরম তুলতে গেলে একপর্যায়ে জানানো হয়, এখানে জটিলতা আছে। এ অজুহাতে আর ফরম নেওয়া যায়নি।’
নেত্রকোনা-২ আসনের নুর খানের আত্মীয় পরিচয়দানকারী এক নেতা জানান, নেত্রকোনা-২ আসনে নুর খান মনোনয়ন পেয়েছেন বলে ধানমণ্ডির কার্যালয় থেকে টেলিফোন করে নিশ্চিত করা হয়। এরই অংশ হিসেবে ধানমণ্ডিতে যাই। একপর্যায়ে জানা যায়, নানা মহলের তদবিরে ঘোষণার মাত্র দুই ঘণ্টা আগে এখানে নুর খানকে বাদ দিয়ে আরিফ খান জয়কে দলের চূড়ান্ত মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। এতে হতাশার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের মতো বড় দলে নেত্রীর (শেখ হাসিনা) সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে এ ধরনের ঘটনা দুর্ভাগ্যজনক।
এদিকে এসব আসনে প্রার্থী বদলের ঘটনাকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছেন না নিজ নিজ এলাকার তৃণমূল নেতারা। ঝিনাইদহ-৩ আসনের এক নেতা বলেন, এখানে নবী নেওয়াজের কোনো অবস্থান নেই। তাঁর আদি বাড়ি নোয়াখালী। স্থায়ী বাসিন্দা যশোরের চৌগাছার। কোনোভাবেই তিনি এ এলাকার সংসদ সদস্য হিসেবে মনোনীত হতে পারেন না। এলাকায় তাঁর কোনো কর্মী-সমর্থক নেই। তিনি জানান, এলাকায় তাঁর চাকরি বাণিজ্য ও ছাত্রলীগের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিটি বাণিজ্য নিয়ে সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ রয়েছে। ছাত্রলীগের কমিটি দেওয়ার নাম করে ১৯ লাখ টাকার বাণিজ্য করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। বিএনপি-জামায়াত অধ্যুষিত এ এলাকায় গত ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হওয়া সহিংস কর্মসূচিগুলো মোকাবিলা করে আসছেন চঞ্চল। সেই চঞ্চলের জায়গায় সাজ্জাতুজ জুম্মাকে মনোনয়ন দেওয়া হলেও কিছুটা সান্ত্বনা থাকত বলে জানান ওই নেতা। এখন মহেশপুর-কোর্টচাঁদপুর এলাকায় আওয়ামী লীগের আর কোনো কর্মীকে মাঠে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।
এ প্রসঙ্গে ঝিনইদহ কোর্টচাঁদপুর উপজেলার সাধারণ সম্পাদক শাজাহান আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, নবী নেওয়াজ এলাকায় রাজনীতি করেন না। তাঁর এখানে রাজনৈতিক কোনো অবস্থান নেই। টাকা-পয়সার মালিক। তাই পোস্টার-ব্যানার করে নির্বাচনের সময়ে মনোনয়ন চান। একতরফা নির্বাচন হলেও এখানে তাঁর পক্ষে জেতা সম্ভব হবে না।
এ প্রসঙ্গে নবী নেওয়াজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চঞ্চলের নাম মাইকে শুনে আমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়ি। আমি ধানমণ্ডি থেকে বাসায় চলে যাই।’ পরে কিভাবে দলের মনোনয়নের চিঠি পেলেন- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি কয়েকজন শীর্ষপর্যায়ের নেতার সঙ্গে যোগাযোগ করি। এরপর রাত ৯টায় আমাকে টেলিফোন করা হয়। আমি চিঠি নিয়ে আসি।’ এর আগে একাধিক নেতা তাঁকে মনোনয়ন নিশ্চিত করেন বলেও জানান তিনি। চঞ্চল ও সাজ্জাতুজ জুম্মার মতো দুজন সাংগঠনিক নেতা থাকার পরও আপনাকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, নির্বাচনে জেতার ব্যাপারে কতটা আশাবাদী- এ প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি শতভাগ আশাবাদী।’ ঝিনাইদহ-৩ নির্বাচনী আসনের স্থায়ী বাসিন্দা নন নবী- এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি স্থায়ী বাসিন্দা না হলেও এ এলাকার মানুষের সঙ্গে আমার নিবিড় সম্পর্ক আছে।’ সবার সঙ্গে সালাম, কুশল বিনিময় এবং যোগাযোগ রক্ষা করেন বলেও দাবি করেন তিনি।