Boxed Style

আইফোন জিতে ক্লিক করুন

Sunday 3 November 2013

সিরিয়ায় বিপ্লব ঘটাবেন কবিরা!

সিরিয়ায় বিপ্লব ঘটাবেন কবিরা!

গাহদা আল-আত্রাস মনে করেন, কবিরা নীরব বিপ্লব ঘটিয়ে চলেছেন- ছবি আল জাজিরাসিরীয় বংশোদ্ভূত নারী লেখক ও অনুবাদক গাহদা আল-আত্রাস। বাস করছেন কানাডায়। কয়েক দশক ধরে সিরিয়ার কবিদের কবিতা নিয়ে গবেষণা করছেন। আরবি ভাষায় লেখা কবিতাগুলো অনুবাদ করছেন তিনি।
সম্প্রতি আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাত্কারে আল-আত্রাস বলেছেন, সিরিয়ায় রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ লেগে যাওয়ার পর সেখানে কবিতাসহ বহুরৈখিক সাহিত্যে যেন নতুন বিপ্লব ঘটে গেছে। প্রতিদিনই কোনো না কোনো কবির কলম জন্ম দিচ্ছে নতুন কবিতার। এর বেশির ভাগই স্বৈরাচার আসাদ সরকারবিরোধী কবিতা।

বদলে যাচ্ছে কবিতার ভাষা ও আঙ্গিকআত্রাস বলেছেন, ‘সিরিয়ায় আজ এমন অবিনাশী সাহিত্যের জন্ম হচ্ছে, যার কথা আমরা কয়েক বছর আগে কল্পনায়ও আনতে পারিনি।’
আল-আত্রাস বলেছেন, সিরিয়ার সাম্প্রতিক কবিতায় একটা বিশেষ ধারা খুব স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে। সেটি হলো, এসব কবিতায় রূপকালংকার ও চিত্রকল্পের মতো বিমূর্ত অনুষঙ্গ খুব সচেতনভাবে এড়িয়ে যাচ্ছেন কবিরা। ‘পদ-লালিত্য ঝংকার মুছে’ দিয়ে এখনকার কবিতার বর্ণনাভঙ্গিতে ব্যবহূত হচ্ছে আক্ষরিক পরিভাষা ও দৃশ্যমান অনুষঙ্গ। অর্থাত্ বিমূর্ত কাব্য-ভাষাকে বাদ দিয়ে সরাসরি বক্তব্য ছুড়ে দিতে তাঁরা চোখা, তীক্ষ ও শাণিত শব্দমালা তুলে ধরছেন। বছর পাঁচেক আগেও যেখানে কবিতার অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল ধর্মীয় বা ধর্মকেন্দ্রিক ব্যঞ্জনা ও উপমা; সেখানে জায়গা করে নিচ্ছে সিরীয় জাতীয়তাবাদসুলভ উপমা-উৎপ্রেক্ষা।
কবিতার প্রত্যাঘাত
সিরিয়ার সমকালীন কবি নাজাত আবদুল সামাদের আরবিতে লেখা একটি কবিতা ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন আল-আত্রাস। ইংরেজিতে এর শিরোনাম, ‘হোয়েন আই অ্যাম ওভারকাম বাই উইকনেস’।
কবিতাটি শুরু হয়েছে এভাবে:
‘সেই কিশোরের স্থির সংকল্প দিয়ে বেঁধেছি বিক্ষত এই হৃদয়ের ব্যান্ডেজ/ রক্তপেশাব না করা অবধি তারা তার অণ্ডকোষে বেধড়ক পিটিয়েছে বিদ্যুতায়িত ধাতব লাঠি দিয়ে/ তার পরও সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে গিয়েছে পরবর্তী বিক্ষোভ জমায়েতে/ সেই সংকল্প দিয়ে বেঁধেছি ক্ষতস্থল/ মন্দ্রসপ্তক চিত্কারে বলে যাচ্ছি, “মৃত্যু নেব, অপমান নেব না।”’
ইউসুফ বোউ ইয়াহিয়া নামের আরেক সিরীয় কবির ‘আমি এক সিরীয়’ কবিতায় উঠে এসেছে প্রচ্ছন্ন জাতীয়তাবোধ। এ কবিতায় তিনি লিখেছেন, ‘আমার জন্মভূমির সৌরভ সুধা আমার সম্প্রদায়/ বৃষ্টিস্নাত, বারিসিক্ত এই মাটি/ আমার সিরিয়া আমার একমাত্র ধর্ম।’
মধ্যপ্রাচ্যে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে আন্দোলনকর্মী হিসেবে কাজ করতে গিয়ে দেশছাড়া হয়েছেন সিরীয় লেখক গিয়াস আল-জান্দি।
তিনি বলেছেন, সিরিয়ার ধ্বংসযজ্ঞের ছাই থেকে ফিনিক্স পাখির মতো উঠে আসছে অসংখ্য সুন্দর কবিতা ও গান। এটি বিপ্লবের সাংস্কৃতিক দিক এবং অবশ্যই একটি তেজদীপ্ত শক্তি।
সিরিয়ার এসব বিপ্লবী কবিতা ছড়িয়ে পড়ছে নানাভাবে। সরকারবিরোধী সমাবেশে কবিরা স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করে আন্দোলন চাঙা করছেন। ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে সেই সব কবিতা। প্রধানত আরবি ভাষায় লেখা এসব কবিতা আল-আত্রাসের মতো কবিরা ইংরেজিতে অনুবাদ করে যাচ্ছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের আরকানসাস বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সিরীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন কবি মোহজা কাহফ ২০১১ সালে সিরিয়ার সাহিত্য নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। সেটির শিরোনাম, ‘সমকালীন সিরীয় সাহিত্যের নীরবতা’। ওই প্রবন্ধে কাহফ লিখেছেন, জনভীতি, আতঙ্ক, সরকারের বিধিনিষেধ, পীড়ন—ইত্যাদি সিরীয় সাহিত্যে স্পষ্ট। তবে সম্প্রতি কাহফ বলেছেন, সিরিয়ার সেই পরিস্থিতি এখন আর নেই। পুরো দৃশ্য পাল্টে গেছে। সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরুর পর সেখানকার কবিতা ও অন্যান্য শিল্পকর্ম অনেক বেশি জোরালো হয়ে উঠেছে। আরও ঝাঁজাল ও শাণিত কবিতা রচিত হচ্ছে গৃহযুদ্ধে প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে পড়া সিরিয়ার মাটিতে।
এ প্রসঙ্গে লেখক গিয়াস আল-জান্দির বক্তব্য হলো, সিরিয়ায় এখন বিশাল ভূমিকা রাখছে কবিতার। বিপ্লবমুখর কাব্য-ভাষা সরকারবিরোধী আন্দোলনে শক্তি জোগাচ্ছে। রাজপথে আন্দোলনকারীদের মুখে স্লোগানের মতো উচ্চারিত হচ্ছে প্রতিবাদী কবিতা।
আসাদ বাহিনীর হামলায় বিধ্বস্ত বাড়িঘর— ছবি রয়টার্সসামাজিক যোগাযোগে কবিরাগাহদা আল-আত্রাস বলেছেন, সিরিয়ার কবিদের নতুন কবিতাগুলোকে তিনি এবং তাঁর মতো আরও অনেকে আরবি থেকে ইংরেজি ভাষায় তরজমা করে ফেসবুকের মাধ্যমে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। তবে আত্রাস মনে করেন, গত দুই বছরে ইন্টারনেটে তরুণ কবিরা ঝড় তুললেও তাঁদের তুলনায় সিরিয়ার বিখ্যাত কবিদের অপেক্ষাকৃত নীরব থাকতে দেখা যাচ্ছে।
প্যারিসে বসবাসরত সিরীয় কবি মারাম আল-মাসরি বলেছেন, ‘সিরিয়ার মানুষ এখন আদুনিসের (সিরিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি আলি আহমাদ সাঈদ এসবার যিনি আদুনিস ছদ্মনামে লেখেন) প্রতিবাদী কবিতা শুনতে চায়।’
আল-মাসরি বলেন, ‘সিরিয়ার বর্তমান প্রেক্ষাপটে আদুনিসের ভূমিকা খুবই কম। এতে আমার মতো বহু সিরীয় হতাশ হচ্ছেন। এ সময় সিরিয়ার আধুনিক কবিতার পুরোধা কবিদের মুখ খোলা উচিত।’

ঝুঁকি, তাড়া করে ফেরে মৃত্যুবাস্তবতা হলো, সিরিয়ার কবিরা এ মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন। সরকারবিরোধী কবিতা লেখার জন্য আসাদ সরকার অনেককেই এ পর্যন্ত নির্যাতন করেছে। অনেককে গুম করা হয়েছে।
গিয়াস আল জান্দি বলেন, ‘দেশজুড়ে কবি-লেখকেরা নিখোঁজ হচ্ছেন। সিরীয় কবি-লেখকেরা এখন দ্বিমুখী বিপদে আছেন। তাঁরা শাসকগোষ্ঠী ও ইসলামপন্থী উভয়ের রোষানলে আছেন। এখানে একটা শব্দ লেখা বা উচ্চারণ করাও ঝুঁকিপূর্ণ।’ তিনি বলেছেন, সিরিয়ার যতজন কবির সঙ্গে তাঁর সম্প্রতি কথা হয়েছে, তাঁদের প্রায় সবাই তাঁকে বলেছেন, যদি আপনি সেখানে সত্য কথা লেখেন বা বলেন, তাহলে আপনি নিশ্চিতভাবে খুন, কারাবরণ ও নির্বাসনের ঝুঁকিতে পড়বেন। এমনকি কেউ বিদেশে পালিয়ে গেলে সেখানে গিয়েও তাঁকে হত্যা করা হতে পারে। 
সিরিয়ার বিশিষ্ট কবি ইব্রাহীম কাসুসকে ২০১১ সালে অপহরণ করার পর হত্যা করা হয়। অন্য দুই লেখক দি’আ আল-আবদুল্লাহ ও তালাল মালুহিকে বিনা বিচারে দীর্ঘদিন আটকে রাখা হয়েছে। কোনো আইনি সহায়তা তাঁরা পাচ্ছেন না। ২০১২ সালে দামেস্কে লেখক খালেদ খলিফার ওপর সন্ত্রাসী হামলা হয়। ওই হামলায় তাঁর বাম হাত ভেঙে যায়।
যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা শক্তির চাপ এবং বিদ্রোহী শিবিরের বেপরোয়া হামলায় কোণঠাসা আসাদ আগের চেয়ে উন্মত্ত হয়ে উঠেছেন। প্রশাসনের ক্রোধের বলি হচ্ছেন ভিন্ন মতাবলম্বী কবিরা। তবে এত কিছুর পরও তরুণ প্রজন্মের কবিরা সোচ্চার। তাঁরা এমন এক সিরিয়ার স্বপ্ন দেখছেন, যেখানে স্বৈরশাসন থাকবে না। সশস্ত্র সুন্দরের অনিবার্য অভ্যুত্থান হয়ে বিকশিত হবে কবিতা।