Boxed Style

আইফোন জিতে ক্লিক করুন

Wednesday 23 October 2013

খালেদা ক্ষমা করলেন, ক্ষমা চাইলেন না

খালেদা ক্ষমা করলেন, ক্ষমা চাইলেন না

কার্টুন: তুলিলগি-বইঠা ও দা-কুড়ালের হুমকির পর রাজনীতিতে এখন প্রস্তাব-পাল্টা প্রস্তাবের খেলা চলছে। শুরু হয়েছে চিঠি চালাচালিও। সংবাদপত্রের পাতায় ও টেলিভিশনের পর্দায় প্রতিদিন নির্বাচনকালীন সংকট সমাধানের দাওয়াই দিয়ে যাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু তাতে সাধারণ মানুষের উদ্বেগ ও শঙ্কা কমছে না।
শুক্রবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকারের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এর বিপরীতে গত সোমবার বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়া নির্দলীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব দিয়েছেন, যাতে ১৯৯৬ সালে ও ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ২০ জন উপদেষ্টা থেকে ১০ জনকে নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের কথা বলা হয়েছে। পাঁচজনের নাম প্রস্তাব করবে সরকারি দল এবং পাঁচজনের নাম প্রস্তাব করবে বিরোধী দল।

  @ Prothom-alo প্রিন্ট সংস্করণ
 
প্রশ্ন হলো, এই প্রস্তাব আদৌ বাস্তবসম্মত কি না? যাঁরা একবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারে গেছেন, তাঁরা কমবেশি তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে ঘরে ফিরেছেন। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যখন জয়ী হয়েছে, দলের নেতারা উপদেষ্টাদের বাহবা দিয়েছেন, আর বিএনপির নেতারা তাঁদের গালমন্দ করেছেন। আবার যখন বিএনপি জয়ী হয়েছে, দলের নেতারা উপদেষ্টাদের নামে জয়ধ্বনি দিয়েছেন, সমালোচনা করেছে আওয়ামী লীগ। গত তিনটি নির্বাচনে এই রেওয়াজই আমরা দেখে আসছি। খালেদা জিয়ার বক্তব্যের পর ওই দুই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একাধিক উপদেষ্টা ‘দ্বিতীয়বার বেলতলায়’ না যাওয়ার কথা বলেছেন।
বিরোধী দল যেখানে দীর্ঘদিন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করছে, সেখানে তারা অনেক চিন্তাভাবনা করে একটি বাস্তবসম্মত প্রস্তাব দেবে—এটাই সবাই আশা করছিলেন। এর আগে বিএনপি-সমর্থক বুদ্ধিজীবীরা নির্বাচনকালীন সরকারের রূপরেখা নিয়ে যেসব কথাবার্তা বলেছিলেন, খালেদা জিয়ার প্রস্তাবে তারও প্রতিফলন নেই। এ পর্যন্ত তত্ত্বাধায়ক সরকারের অধীনে তিনটি নির্বাচন হয়েছে। বিরোধী দলের নেতা কেন ২০০৮ সালের সরকারটি বাদ দিলেন? খালেদা জিয়া বলেছেন, রাষ্ট্রপতি, স্পিকার ও সংরক্ষিত মহিলা আসনে যেভাবে নির্বাচন করা হয়, ১১ উপদেষ্টাকে সেভাবেই সংসদ ভেঙে দেওয়ার আগে নির্বাচিত করিয়ে আনা যেতে পারে। দুই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ২০ উপদেষ্টার বাইরে তিনি কোনো নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে খুঁজে পেলেন না। আবার বললেন, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একজন ব্যক্তিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করতে। বিষয়টি স্ববিরোধী।
এসব শুনে এক সাংবাদিক বন্ধুর মন্তব্য: বিরোধী দলের নেতা শীতের ওয়াজ গ্রীষ্মে দিলেন। নির্বাচনের পরের বক্তৃতাটি আমরা আগেই শুনলাম।
খালেদা জিয়া এর আগে রোববার পেশাজীবী সমাবেশে বলেছিলেন, ‘বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচনে বিএনপি যাবে না। ...আপনারা কেউ পাশে থাকুন, আর না থাকুন, আমি একলা হলেও দাবি (তত্ত্বাবধায়ক সরকার) আদায় করে ছাড়ব।’
প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, ‘আমি বিরোধী দলের নেতাকে অনুরোধ করছি, তিনি আমার এই ডাকে সাড়া দেবেন। আমার অনুরোধ রক্ষা করবেন এবং আমাদের যে সদিচ্ছা তার মূল্য দেবেন।’ জবাবে বিরোধী দলের নেতা বলেছেন, ‘আমি আশা করি শান্তি, স্থিতিশীলতা ও গণতন্ত্রের স্বার্থে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমার প্রস্তাব গ্রহণ করবেন।’ পরস্পরের প্রতি তাঁদের এই আহ্বান ও অনুরোধের প্রতিফলন যদি দৈনন্দিন আচরণে প্রতিফলিত হতো, যদি তাঁরা একে অপরের বিরুদ্ধে যুদ্ধংদেহী মনোভাব না দেখাতেন, তাহলে অনেক সমস্যারই সমাধান হয়ে যেত। এখন পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, এক নেত্রী যত নরম ভাষাতেই কথা বলুন না কেন, অন্য নেত্রী তাঁর প্রতি আস্থা রাখতে পারছেন না। ফলে সন্দেহ আর অবিশ্বাসের দেয়াল ক্রমশই চওড়া হচ্ছে। সংকট সমাধানের সম্ভাবনাও ক্ষীণ হয়ে পড়ছে। প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান যদি আন্তরিক হতো, তাহলে তিনি পরদিনই ঢাকায়
সভা-সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করতেন না। আবার বিরোধীদলীয় নেতা যদি সরকারের সঙ্গে সমঝোতাই চাইতেন, তাহলে তিনিও পেশাজীবী সমাবেশে একলা লড়াই করার ঘোষণা দিতেন না।
সংবাদ সম্মেলনে বিরোধীদলীয় নেতার বক্তব্য প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবের প্রতিক্রিয়া হলেও তিনি বেশি সময় ব্যয় করেছেন নির্বাচন-পরবর্তী সরকারের ধারণা, রাষ্ট্র পরিচালনার কৌশল, প্রতিবেশীদের সম্পর্ক ইত্যাদি নিয়ে। অর্থাৎ বিরোধী দলের নেতা ধরেই নিয়েছেন, আগামী নির্বাচনে তাঁর দল বা জোট ক্ষমতায় আসছে। একটি রাজনৈতিক দলের নেতা হিসেবে তাঁর এই আত্মবিশ্বাস থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু সেই আত্মবিশ্বাসকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে তো তাঁকে নির্বাচনে আসতে হবে।
এ মুহূর্তের প্রধান সমস্যা কী? নির্বাচন, না নির্বাচন-পরবর্তী সরকারকাঠামো?
খালেদা জিয়া বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবে অস্পষ্টতা আছে। সে ক্ষেত্রে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে প্রস্তাবটি স্পষ্ট করার কথা বলতে পারতেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান কে হবেন, সে সম্পর্কে কিছু বলা নেই। বিরোধীদলীয় নেতা সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব দিতে পারতেন। সেসব না করে তিনি পুরোনো উপদেষ্টাদের সামনে এনে পরিস্থিতি আরও জটিল করলেন। ২০১৪ সালের সংকটের সমাধান ১৯৯৬ সালের ফর্মুলা দিয়ে যে সম্ভব নয়, তা রাজনীতির অ আ জানা ব্যক্তিটিও বোঝেন।
খালেদা জিয়া তাঁর বক্তব্যে অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়ার কথা বলেছেন। কিন্তু তিনি অতীতের ভুলের জন্য দুঃখ প্রকাশ বা ক্ষমা প্রার্থনা করেননি। খালেদা জিয়া বলেছেন, ‘মানুষ ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে নয়। এই কথা স্বীকার করতে আমার কোনো দ্বিধা নেই যে অতীতে আমাদেরও ভুলভ্রান্তি হয়েছে। তবে একই সঙ্গে আমি বলতে চাই, ওই সব ভুল থেকে আমরা শিক্ষা নিয়েছি। আগামীতে একটি উজ্জ্বল, অধিক স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের পথে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে আমরা ভালোভাবে প্রস্তুতি নিয়েছি। তাই আমরা অতীতের ভুলগুলো পুনরাবৃত্তি করব না।’
আমাদের প্রশ্ন, বিরোধীদলীয় নেতা যে অতীত থেকে শিক্ষা নিয়েছেন, তার প্রমাণ কী? তাঁর দল এখনো সেই পুরোনো ধারাই চলছে। ক্ষমতায় থাকতে যেসব নেতা সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও জঙ্গিবাদের সঙ্গে নানাভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন, তিনি তাঁদের কাউকে বাদ দেননি। এমনকি বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে দেশে যে জঙ্গিবাদের উত্থান হয়েছিল, সারা দেশ গ্রেনেড ও বোমার ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন ছিল, সাধারণ মানুষ নিয়ত শঙ্কা ও ভয়ে ছিল, সে কথা বিরোধীদলীয় নেতা স্বীকারই করেননি। তাহলে অতীতের ভুল তিনি সংশোধন করবেন কী করে।
বিরোধীদলীয় নেতার ভাষণের সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক অংশ হলো ক্ষমা ঘোষণা। তিনি বলেছেন, ‘আমি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করছি যে যাঁরা আমার এবং আমার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে অতীতে নানা রকম অন্যায়-অবিচার করেছেন, ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছেন এবং এখনো করে চলেছেন, আমি তাঁদের প্রতি ক্ষমা ঘোষণা করছি। আমি তাঁদের ক্ষমা করে দিলাম। সরকারে গেলেও আমরা তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিশোধ নেব না।’
এখানে উল্লেখ করার বিষয় হলো, বিরোধী দলের নেতা ‘তাঁর ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের ওপর অন্যায়-অবিচারের কথা বললেও পরিবারের বাইরে বিএনপির যে হাজার হাজার নেতা-কর্মী অন্যায়-অবিচার ও জেল-জুলুমের শিকার হয়েছেন, তাঁদের সম্পর্কে একটি কথাও বললেন না। এ থেকে ধারণা করা হয় যে, দলের নেতৃত্ব কর্মীদের কথা মুখে বললেও অন্তরে পোষণ করেন না। সেখানে শুধুই পরিবার। আসলে গণতন্ত্রের নামে তাঁরা পরিবারতন্ত্রই কায়েম করছেন।
বিরোধী দলের নেতা কার প্রতি ক্ষমা ঘোষণা করলেন? ক্ষমা তখনই ঘোষিত হয়, যখন আইনের চোখে কেউ অপরাধ করে। আবার সব অপরাধ ক্ষমাযোগ্যও নয়। কেউ যদি খুন করে এসে বলেন, আমাকে ক্ষমা করে দিন। তিনি নিশ্চয়ই ক্ষমা পেতে পারেন না। খালেদা জিয়া যাদের উদ্দেশে একতরফা ক্ষমা ঘোষণা করলেন, তারা কি সত্যি সত্যি নিজেদের অপরাধী মনে করেন? তিনি কেবল বর্তমান নয়, অতীতের অন্যায় অবিচারের কথাও বলেছেন। তারা কি রাজনৈতিক শক্তি, না অরাজনৈতিক শক্তি? তাঁর এ ঘোষণা সেই শক্তিই বা কীভাবে নেবে?
খালেদা জিয়া এবং তাঁর পরিবারের কোনো সদস্যের প্রতি যদি অন্যায়-অবিচার হয়ে থাকে, সত্যিই তা দুঃখজনক। আমরা এর আইনি প্রতিকার চাই। বিচারের দাবি করছি। একইভাবে তাঁর শাসনামলে যদি কেউ অন্যায়-অবিচারের শিকার হয়ে থাকে, তার জন্যও সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁকে জবাবদিহি করতে হবে। তাঁর শাসনামলেই ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মতো নৃশংসতম ঘটনা ঘটেছে। তাঁর আমলেই সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়াসহ বহু রাজনৈতিক নেতা সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হয়েছেন। এসব বোমাবাজি, গ্রেনেডবাজি ও খুনের বিচার করেননি কেন—এই প্রশ্ন যদি খালেদা জিয়াকে করা হয়, তিনি কি জবাব দেবেন? তাঁর আমলে সংঘটিত অন্যায়-অবিচার, সন্ত্রাস, দুর্নীতির দায় স্বীকার করে তিনি জনগণের কাছে ক্ষমা চাননি। কেবল প্রতিপক্ষের প্রতি ক্ষমা ঘোষণা করেছেন। এই ঘোষণাও একধরনের ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ।
খালেদা জিয়া ঘোষণা দিয়েছেন, ভবিষ্যতে তাঁর দল যে সরকার গঠন করবে, তা হবে সব নাগরিকের প্রতিনিধিত্বকারী সরকার। মেধা ও মননশীলতার সরকার। খুবই ভালো কথা।
কিন্তু আমাদের প্রশ্ন, খালেদা জিয়ার প্রস্তাবিত সব নাগরিকের প্রতিনিধিত্বকারী সরকারে কি শাপলা চত্বরের হেফাজতি ও জামায়াতিদের প্রাধান্য থাকবে? মৌলবাদী, ধর্মবাদীরাই কি তাঁর ঐকমত্যের সরকারের শরিক হবে? তাঁর দল ক্ষমতায় এলে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের সেই আশাদীপ্ত তরুণদের ভাগ্যে কী ঘটবে, যাঁদের তিনি নাস্তিক বলে অভিহিত করেছিলেন? তাঁর দল ক্ষমতায় এলে বর্তমানে যুদ্ধাপরাধের দায়ে যাঁদের বিচার চলছে, তাঁদের কি জেলখানা থেকে বের করে এনে আবার মন্ত্রীর আসনে বসাবেন?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net